আজ

“সেইসব লেখা”—আহমদ ছফার এক খুচরো সংকলন




এমরান হোসেন রাসেল©


শুরুতেই ব’লে রাখা ভালো, আমি কোনও গবেষক কিংবা পণ্ডিত নই। নিজের জাত আর অন্যের ঘাত থেকে আত্মরক্ষার্থে পাঠক পরিচয়ে— পরিচিত হইএই নিবন্ধের বক্তব্য আপনাদের অজানা, এমন ধৃষ্টতা আমি করবো না। সবই আপনারা জানেন।

লেখ্যবৃত্তি পবিত্র কাজ। এরচেয়ে পবিত্র লেখকের স্বাধীনতা। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ লেখকদের কথা বলছি। যাঁরা সাম্য আর উদার মানসিকতার আদর্শে বিশ্বাসী। সাহিত্য যাঁদের দেশ ও জাতির সেবা করার হাতিয়ার। জনমানুষের অব্যক্ত ভাষা, আনন্দের ধারা আর কল্যাণ বিধানে লেখনীকে সুফলপ্রসূ ব্যবহার করা যাঁরা জীবনের ব্রত মনে করেন। আর্ট এঁদের কাছে কোন শৌখীনতা নয়, ব্যক্তিক অভিব্যক্তি লক্ষ্যহীন লীলাবিলাসের চর্চা বিষয় নয়, বরং এক মহান সামাজিক কর্ম। তাঁদের সাহিত্যকর্মের প্রতি পরতে পরতে গভীর দায়িত্ববোধ থাকে। সমাজ চৈতন্য দ্বারা অনুপ্রাণিত, সমষ্টির ভাবনায় দীপ্ত। রাজভয়, লোকভয় আর মৃত্যুভয় কোন ভয়ই যাঁদের কাবু করতে পারে না।  ক্ষমতাবানদের অনুগ্রহের অপেক্ষা আর নিগ্রহের পরোয়া না করে সত্যবাক্য খরখড়্গের মতো ঝলসিয়ে উঠা হলো যাঁদের সংকল্প। এমনই একজন লেখক— আহমদ ছফা।


সেইসব লেখা— আহমদ ছফার লেখার একটি খুচরো সংকলন বলা যেতে পারে; কারণ আহমদ ছফার অগ্রন্থিত ও অপ্রকাশিত লেখাগুলো থেকে বাছাইকৃত প্রবন্ধের সংকলন। বইটিতে বিভিন্ন  বিষয়ে লেখা প্রবন্ধের সমাবেশ ঘটেছে। সব-বিষয়ে আলোচনা এই ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব না আর সব-বিষয়ে কথাও কেউ বলতে পারেন না।

আহমদ ছফা নিজের লেখা সম্পর্কে বলে গেছেন—

“হাইস্কুলে গিয়েই ভাবতে শুরু করলাম আমার কাজ হবে রাজনীতি। কারণ রাজনীতির মাধ্যমে আমি দেশের মানুষের সেবা করতে পারবো। ছাত্রজীবনে আমি কৃষকের রাজনীতি করেছি এবং কৃষক রাজনীতিতে বলতে গেলে একদম ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। যদিও রাজনীতি করার স্বপ্ন জীবনের নানা বাঁকে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে, কিন্তু আমার রাজনীতিতে টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। তার পরে আমি ভাবলাম আমার কাজ হবে আমলা হওয়া। পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়েছিলাম। মৌখিক পরীক্ষায় পাশও করেছিলাম। ঐ পেশায় যদি লেগে যেতাম আজকে একথা বলার অবকাশ থাকতো না। তারপর আমি ভাবলাম আমি জাঁদরেল পণ্ডিত হবনানা বিষয়ে বেশ পড়াশোনাও করতে চেষ্টা করেছি। রিসার্চ স্কলার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বাংলা একাডেমীতে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছি। পরিবেশ-পরিস্থিতি থাকলে হয়তো আমি একটা ভয়ংকর পণ্ডিত হয়ে উঠতে পারতাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের জ্ঞানবুদ্ধির বহর দেখে আমার সে আকাঙ্ক্ষা নষ্ট হল...

... আমাকে সকলে যখন ছেড়ে যায়, সবকিছু যখন ছেড়ে যায়, তখনই আমি লেখার কাছে ফিরে আসি, ফিরে আসতে হয়। এটা যেন আমার নিয়তি। বন্ধুবান্ধব অনেকে আছেন তাঁদের নিজের লেখা সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চকণ্ঠ। কিন্তু আমার সেইরকম কিছু ঘোষণা দেয়ার সুযোগ কই। আমি তো বরাবর পালিয়ে এসে লেখার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করি।”

সবাইকে রাজনীতির মঞ্চে উঠেই রাজনীতি করতে হবে এমন কোন স্বতঃসিদ্ধ সূত্র নেই। উপযুক্ত সময়ে ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে মানব-কল্যান, সাম্য-প্রতিষ্ঠা আর অন্যায্যকে নির্বাসিত করতে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চের দরকার পড়ে না। রাজনীতি আর সাহিত্য উভয়ের উৎসই মানুষ। সাহিত্য মানুষকে ভেতর থেকে তৈরি করে, কোন নির্দেশ দেয় না; নির্দেশ দিলে সাহিত্য অচল। অপরদিকে নির্দেশ দিতে না পারলে রাজনীতি চলে না, ভেতর থেকে তৈরির প্রয়োজন রাজনীতিতে খুব একটা জরুরী বিষয় নয় রাজনীতি নির্দেশ দেয়, বাধ্য করে, সময় সময় স্বাধীনতা হরণও করে, কিন্তু সাহিত্য মানবিকতার বোধকে প্রশস্থ করে, স্বাধীনতা ও স্বতঃস্ফুর্ততার বোধটিকে চাঙ্গা করে কোন রকম বাধ্য-বাধকতার বিরোধীতা করে। উভয়ের উৎস এবং কর্মকাণ্ড মানুষকে নিয়ে। রাজনীতি মানুষকে ভৌগলিক স্বাধীনতা দান করে, সাহিত্য মানুষকে চিন্তার স্বাধীনতা দান করে। সাহিত্য মানুষের মন ও মনন গঠনে সাহায্য করে, তেমনি রাজনীতিরও একটি মনন প্রয়োজন। মননহীন রাজনীতি ক্ষমতার চর্চা এক আসুরিক অনুশীলন পদ্ধতিমাত্র।

ছাত্র জীবনে কৃষকের জন্য রাজনীতি করা আহমদ ছফা খেটে খাওয়া মানুষের সাহিত্য প্রসঙ্গে দু’চার কথা বলবেন না, তা কেমন করে হয়। সমাজের নিচুতলার মানুষের বঞ্চনাপীড়িত জীবন তার মননকে সর্বদা পীড়া দিত। তিনি মনে করেন এ বিষয়ে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘কয়লাকুঠি’ বাংলা সাহিত্যে লেখা প্রথম সাহিত্যকর্ম, যেখানে খেটে খাওয়া মানুষের বেদনা-বঞ্চনার শৈল্পিক রূপায়ণ ঘটেছে। নজরুল ইসলামের ‘মৃত্যুক্ষুধা’ পাত্র-পাত্রীরাও নিচুতলার, তাদের ভাষাও ভদ্রলোকের শুদ্ধ বাংলাভাষা নয়। নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’-কে বাংলাসাহিত্যে একটি বিশিষ্ট রচনা দাবী করলেও তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, এর কৈফিয়ত তিনি দিয়েছেন এভাবে—


“নজরুল ইসলাম মৃত্যুক্ষুধা যেভাবে শুরু করেছিলেন যদি সেভাবে শেষ করতে পারতেন তাহলে এটা আশ্চর্য একটা উপন্যাস হয়ে উঠতে পারত। নজরুল ইসলাম ছিলেন অশান্ত প্রকৃতির মানুষ। সঙ্গীত ছাড়া অন্যকিছুতে দীর্ঘ সময়ের জন্য থিতু হয়ে থাকার ধাত নজরুল ইসলামের ছিল না। তাছাড়া কবিতা এবং গান লেখার ঝোঁক বারে বারে তাঁর মনোসংযোগের উপর হামলা করেছে।”


রবীন্দ্রনাথের প্রভাবমুক্ত হওয়ার জন্য তৎকালীন তরুণ লেখিয়েরা নতুন বিষয়, নতুন প্রকাশভঙ্গী খোঁজা শুরু করেন। প্রেরণা-সঞ্চারের উৎস হিসেবে কার্ল মার্কস আর সিগমুন্ড ফ্রয়েডের উপর তাঁরা আস্থা রাখেন। ফলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, গোলাম কুদ্দুস, বিঞ্চু দে, গোপাল হাওলাদার, দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতো আরো অনেকেই ভুখা-নাঙ্গা শোষিতদের নিয়ে সাহিত্য রচনা করতে মনোনিবেশ করেছিলেন। মার্কবাদে পুরোপুরি আস্থাশীল নন এমন কবি-সাহিত্যিক গণজাগরণের পক্ষে কলম ধরেন। এমন লেখক হিসেবে আমরা অদ্বৈতমল্ল বর্মণ এবং বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ করতে পারি।

কবির ভাষায় বলতে হয়—
আমরা দুনিয়ায় খেটে খাওয়া মজদুর শ্রেণী
কেউ খাটি লেদে কেউ খাটি মিলিংয়ে
কেউ খাটি ফার্নেসে কেউ খাটি শেপিংয়ে
       এই সব মিলে মোরা কাজ করি।
পৃথিবীর সব দেশ জুড়ে মোরা জানি
আমরা এযুগের বঞ্চিত শ্রেণী।

এই শ্রেণির মানুষগুলোর ভাবনা তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সারা জীবন। জীবনাবাদী সমাজসচেতন আহমদ ছফা নিজ জীবনেও এসব মানুষের আত্মিক উন্নতি, আর্থিক উন্নতির ভাবনা থেকে স্কুল প্রতিষ্ঠান করেন। নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে দেখি কয়েকবছর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশাল লেখা-ভাণ্ডারে খেটে খাওয়া মানুষ নিয়ে যে সামান্য লেখা পাওয়া যায়, সেটাতেও ছফা সন্তুষ্ট; তাকে ধন্যবাদ দিতে কার্পণ্য করেননিরবীন্দ্রনাথ একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমি যখন লিখিতে আরম্ভ করিয়াছি বঙ্গ-সাহিত্যে তখন রাজপুতনার যুগ চলিতেছে।’ কথাটি ঘুরিয়ে ছফা বলতে চেয়েছেন, আসলে উনার অগ্রজ ভাই-বোন জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর আর স্বর্ণকুমারী দেবী অধিকাংশ রচনাই রাজপুতনার কোন না কোন ঘটনাকে উপলক্ষ করে লিখিত।

তাই ছফা বলেন

“ঠাকুরবাড়ির সে পরিবেশেও রবীন্দ্রনাথ সমকালীন সময়ের আহ্বান শুনতে পেয়েছিলেন সেটাই আশ্চর্য।”

রসাত্মকভঙ্গীর একটি লেখা “সাহিত্যের জাতীয়করণ”। গল্পটি এমন

সদ্য স্বাধীন দেশ। দেশের বিভিন্ন মহল অদৃশ্য মন্ত্রবলে লাখ টাকার (তৎকালিন) মালিক হয়েছে। লেখক-সাহিত্যিকরা শুধু বঞ্চিত; তাঁদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। এইসব সাহিত্যিকরা মাথা লুঠিয়া, হৃদয় চুলকাইয়া, কলম ভরিয়া, আনন্দে হাসিয়া, দুঃখে কাঁদিয়া যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, তখন এনারা সাহিত্য-সংস্কৃতির জাতীয়করণের কল বসাতে স্থির করলেন। সাহিত্যের ফ্যাক্টরি বসানো হোক, মানুষ বেছে বেছে চালক, উপচালক করা হোক। এত সুন্দর প্রস্তাবে লেখক-সাহিত্যিকরা খদ্দরে পাজামা-পাঞ্জাবি পড়ে, গাড়ি হাঁকিয়ে আর মাথা ঝুকিয়ে ভক্তিরসে গদগদ হয়ে সরকারপ্রধানের ভবনে ঘনঘন আসা-যাওয়া শুরু করলেন। ভারতীয় সাহিত্যের কল বসিবে, সাহিত্যের এই ফ্যাক্টরিতে নাট-বল্টু ঘুরানোর লোক, মেসিনম্যান, লোক-সাহিত্যের ঘুঁটে সংগ্রহকারী, সাহিত্যিক জেনারেল এবং জেনারেলকে তোয়াজ করার হেকমতি লোক দরকার পড়লো। হঠাৎ একদিন সরকার নিজ পছন্দের পরিচালক জাতিকে উপহার দিলেন। যিনি  আঠারো আনায় টাকা গুণেন। আধ-পাগল আর আধ মুদিদোকানদার মার্কা পরিচালক নিজেকে মহাপরিচালক ঘোষণা করলেন। মহাপরিচালক সম্মোধন না করায় তিনজনের চাকরি গেল। এমন ক্ষমতাধরের মনে উদয় হলো কোলকাতা পূণ্যভূমি দর্শন করা, করলেন। রাজকীয় বাড়িতে থাকার সাধ জাগল, তোষামোদী দল খুঁজে এক উর্দুওয়ালার বাড়ি ঠিক করে দিলো। পুত্র-কন্যা-জায়া আর শ্যালিকা নিয়ে বাড়িতে উঠলেন ঠিকই, সমস্যা করলো পত্রিকাওয়ালারা। কাউকে ধমকিয়ে, কাউকে গুণ্ডা ভাড়া করে ঠাণ্ডা করা হলো। বিদেশে গিয়ে ভাষণে তের মিনিট কেশে নিজের প্রকৃত (অ)সাহিত্যিক পরিচয় দান করেন। স্বাধীনতা-উত্তর দেশের পরিস্থিতি রূপক-উপমায়, তীর্যকভাষায় সুন্দর করে বর্ণনা করার সাহস এবং ক্ষমতা আহমেদ ছফারই ছিল। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি জাতির আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান আর আত্ম-উৎকর্ষ গঠনে যাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তারা অনেকেই নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। সে এক ভয়ঙ্কর অসৎ সময় জাতি কাটিয়েছে। সময়ের স্রোতে উচিত্ত-জ্ঞান বিসর্জন না দিয়ে, শুধুমাত্র নীতি আর সাহসে ভর করে সমস্ত অশুভের মোকাবেলা করা দৃঢ়চেতার পরিচয় আহমদ ছফা উপযুক্ত সময়ে দিয়ে ছিলেন।


১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ বাংলাদেশে লেখক শিবিরের পক্ষ থেকে “ভবিষ্যতের বাংলা” নামে একটি সেমিনার করা হয়। সেমিনারের উদ্দোক্তা ছিলেন তিনজন আহমদ ছফা, কবি হুমায়ুন কবির আর ফরহাদ মাজহার। বক্তব্য রেখেছিলেন ড. আহমদ শরীফ, ড. মমতাজুর রহমান, সরদার ফজলুল করীম, ড. সিরাজুল ইসলাম, কবীর চৌধুরী, ড. বোরহান উদ্দিন জাহাঙ্গীর এবং উদ্দোক্তা তিনজন।  উদ্দেশ্য ছিল দেশের পণ্ডিতজনদের মতামত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতির পক্ষে সহায়ক হবে এবং তাঁদের (উদ্দোক্তা তিনজন) ধারণায় আসন্ন রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে কিছুটা প্রভাব ফেলবে। এই পণ্ডিতজনের সেদিন বাঙালি জাতির ঠিকুজিকুলজি নিয়ে এন্তার আকর্ষণীয় বক্তব্যের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে থাকলেও মোক্ষম তত্ত্বটি প্রায় সবাই এড়িয়ে গেছেন। অর্থাৎ যুদ্ধ আসন্ন, আমাদের কাঁধে এই বিশাল দায়িত্ব তুলে নিতে হবে। অনুষ্ঠান শেষে শ্রোতার উনাদের তিনজনের বক্তব্যের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলেও, পণ্ডিতজনদের কেউ কেউ এই গোয়ার্তুমির জন্য তাঁদের ভয়ংকর বকাঝকা করেছিলেন। আহমদ ছফা দাবী করেন তাঁর স্পষ্ট মনে আছে যে,

“...চৌধুরী সাহেব বলেছিলেন, আমরা হঠাৎ করে সকলকে কসাইখানায় থাকবার ব্যবস্থা করছি। দেশ স্বাধীন হোন না-হোক আমাদের আগে ভাগে ঘোষণা দেবার কি দরকার ইত্যাদি ইত্যাদি।”

২০ বছর পর অর্থাৎ ১৯৯১ সালের ২৩শে মার্চ দৈনিক ভোরের কাগজে ড. সিরাজুল ইসলাম যা দাবী করেন তা আহমদ ছফার লেখায় আমরা জানি এই—

“...তাঁরা ‘ভবিষ্যতের বাংলা’ শিরোনামে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন। এই সংবাদটুকু প্রদান করেই চৌধুরী সাহেব ক্ষ্যান্ত থাকেননি। তিনি যে ‘বাংলার ভবিষ্যৎ’ সম্পর্কে খুব বড় করে ভেবেছিলেন সেকথাও ঐ সেমিনারে প্রকাশ করেছিলেন।”

তিনি সেই সভায় উপস্থিত একজন ড. আহমদ শরীফকে ফোন করে নিজের স্মৃতির পরীক্ষা নেন এবং ড. শরীফের সম্মতি আদায়ক্রমে ভোরের কাগজে প্রতিবাদ প্রকাশের চেষ্টা করে বিফল হন। পরে ‘অগ্নিসাক্ষী’তে প্রতিবাদ ছাপেন।

এখানে একজন দৃঢ়চেতা আহমেদ ছফার পরিচয় পাওয়া যায়। দেশের একজন শীর্ষ-স্থানীয় বুদ্ধিজীবীর ইতিহাসের ফাঁক-ফোকর গলে সুবিধা নেওয়াটিকে যথাযথ সম্মান প্রদানপূর্বক সবার সামনে এনেছিলেন। তাঁকে পত্রিকা-অফিস সাহায্য না করলে তিনি অন্যত্র প্রতিবাদটি ছাপতে বাধ্য হন। নির্ভীক ছফা এই ঘটনায় আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, প্রতিবাদ করাটা কত দরকারীএবং আশঙ্কা করেছিলেন কোনদিন হয়তো এই ভীরুরা জনসভায় গিয়ে ঘোষণা দেবেন স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক তো আমরাই দিয়েছিলাম। মিথ্যাবাদের এই প্রক্রিয়া ধারাবাহিক চলমান থাকলে একদিন রাজাকার, আলবদররা বলবে আসলে আমরাই স্বাধীনতা-সংগ্রামটা করেছিলাম। আজকের দিনে তিনি বেঁচে থাকলে দেখতে পেতে যে তার এই শংকাটিই বাস্তবায়িত হয়েছে। তাঁর লেখার শেষের বাক্যটি যেন আজকের দিনকেই ঈঙ্গিত করে “সেই দিনটি কি খুব দূরে।”

সাহিত্যের শীর্ষের লোকেরাও ঈর্ষা, হিংসা, ঘৃণা, লোভের উর্ধ্ব যেতে পারেন না; বিষয়টি আমাদের মতো সাধারণের জন্য বেশি যন্ত্রণাদায়ক। দু’জন শিখরে স্থিত সাহিত্যিক পরস্পরে ছোট করলে তা থেকে অশিষ্ট, অভব্য আর অনাচার প্রকাশ পায়। যা আমাদের ভালোকিছু শেখায় না। ১৯৯৫ সালের ২৪শে ডিসেম্বর বাংলাবাজার পত্রিকায় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের একটি সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় কিস্তি ছাপা হয়, আর প্রথম কিস্তি ১০ই ডিসেম্বর। দ্বিতীয় কিস্তিতে তিনি হাসান আজিজুল হকের গল্প নিয়ে নেতিবাচক কিছু মন্তব্য করেন। যা এই দুই শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিকের জন্য বেমানান। ছফা মৃদ্যু ভাষায় স্মরণ করিয়ে দেন, তরুণ সমাজ সবসময় অগ্রজদের দিকে তাকিয়ে থাকে;  সুস্থ ও সুন্দর বির্তক কীভাবে করতে হয় তা চাই না-চাই সেটা তরুণদের শিক্ষা দেওয়া অগ্রজদের কাজ। যদি সেই দায়িত্বে কেউ অবহেলা করে তবে ভবিষ্যতের কাল কাউকে ক্ষমা করবে না। এখানে আল মাহমুদের আরেকটি বিষয় তিনি দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করেন যে, আল মাহমুদই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা লেখক নন। হতে পারেন তিনি বড় লেখক কিন্তু একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা লেখক নন।

কোন আরাধ্য বস্তু হস্তগত হওয়ার পর কেমন অনুভব হয়? আনন্দ ! হ্যাঁ, সত্যই আনন্দ লাগে। যদি বস্তুটি অমূল্য হয় তবে সাথে আরো একটি প্রত্যয় অনুভব হয়—হারানোর ভয়। প্রাপ্ত বস্তুটিকে ধরে রাখতে, বাঁচিয়ে রাখতে বা যথাযথ রাখতে ব্যবস্থা কী কী হবে তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বুদবুদ চিন্তাশীলমাত্রই হয় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের এক সীমাহীন আনন্দের দিন। সেইদিন প্রতিটি মুক্তিকামী বাংলাদেশি যখন মুক্তির বার্তাটি পান নিঃসন্দেহে সেই অনুপলটি তাঁর জীবনের সর্বোচ্চ আনন্দের এবং স্মরণীয়। আহমদ ছফা এই বার্তাটি ১৬ই ডিসেম্বরের সকাল দশ-এগারটার দিকে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা ভবনে অবস্থানকালে দিলীপ চক্রবর্তীর কাছ থেকে পানসেই সময়টিতে হঠাৎ বাজি পোড়ানো এবং পটকা ফাটানোর শব্দে সমস্ত কোলকাতা মহানগর প্রকম্পিত হয়ে উঠলে দিলীপবাবুর মুখেই তিনি জানতে পারেন যে, ঢাকা ফল করেছে অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে’। ছাত্র-শিক্ষকেরা সবাই মিলে জয়ধ্বনি তুলছিলেন এবং তার সাথে গলা মিলিয়ে ছফাও ‘হুর রা’ চিৎকার করে উঠেন। কিন্তু পরক্ষণেই তার কাছে মনে হয় 

“আমরা স্বাধীন হলাম। ভারত আমাদের স্বাধীন করে দিল। তারপর ! তারপর আমাদের কী হবে? সব জিনিসের তো একটা দাম আছে। বিনিময় কী দিতে হবে আমাদের? সম্মিলিত জয়ধ্বনির মধ্যে একটি অসহায়তাবোধ আমাকে চারদিক থেকে এসে গ্রেফতার করে ফেলল”

রাষ্ট্র সমাজের দেহ, আত্মা নয়। আত্মা ব্যক্তি। ব্যক্তি মানে সব মানুষ নয়, কিছু মানুষ। এই বিশেষ মানুষগুলো কোন ঘটনার অন্তর্নিহিত সারবস্তু উপলব্ধি করতে পারেন। সৌন্দর্য আর আনন্দের মাঝে সুপ্ত, ঘুমন্ত হেতুগুলো তাঁরা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পান। যেমনটি আহমদ ছফা আর এই প্রবন্ধে আমাদের জানিয়ে গেছেন। সব জিনিসেরই দাম মেটাতে হয়। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালির সবচেয়ে অমূল্য সম্পদ স্বাধীনতা, এরজন্য যে আমাদের আরো দাম মেটাতে হতে পারে, তা যেন সেই শুভক্ষণেই আহমদ ছফার মনের গহীনে ভাংগাচোরা করছিল।

পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাংতে অনেক দশক, কোনও কোনও ক্ষেত্রে অনেক শতক সাধনা করতে হয়। অনেক ত্যাগের ইতিহাস, রক্তঝরার কাহিনী এই ইতিবৃত্তের সাথে জড়িয়ে থাকে। এই আরদ্ধ স্বাধীনতা খোয়াতে আদৌ তেমন সময়ের প্রয়োজন হয় না। সৈন্যসামন্ত নামিয়ে কোন স্বাধীন দেশকে পরাধীন করার ব্যবস্থা বা কৌশল মান্ধাতার আমলের, এটা আজ সর্বজন স্বীকৃত। কোনদেশের পরাধীন হওয়ার জন্য সার্বভৌমহরণ আজ কোন প্রয়োজনীয়তার দাবী রাখে না। একটি দেশের আর্থিক কলাকৌশলে দেশিয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে, দেশকে সহজ-সস্তা ঋণের লোভ দেখিয়ে, ঋণের ফাঁদে ফেলে এবং নতুন নতুন প্রযুক্তির লোভ দেখিয়ে বৈদেশিক ঋণের পরিমান ক্রমশ বাড়িয়ে, সেই দেশের ক্ষুদ্র-বৃহৎ শিল্প বা বাজারকে ধ্বংস করে নিজেদের বাজার সৃষ্টি করে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রন করা পরাধীনতার নামান্তর। আমরা পাকিস্তানিদের গোলামী থেকে মুক্ত হয়েছিলাম ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সনের এক শুভক্ষণে এটা সত্য। কিন্তু স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পরও আমরা প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ কতটুকু পাচ্ছি? একটু অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখলেই স্পষ্ট পরিষ্কার হবে।

একটি জাতির উন্নতির মানদণ্ডে শিক্ষা-সংস্কৃতি অন্যতম বিচার্য বিষয়। সংস্কৃতি অর্থাৎ কালচার কথাটির মূল অর্থটা ছিল কৃষি। চাষের কথা থেকেই কথাটি এসেছিল, যেখানে মন হলো কৃষিক্ষেত্র। যেখানে চাষ করলে ফসল ফলে, না করলে পতিত জমি হয়ে থাকে। সংস্কৃতির সাথে শিক্ষা ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। দু’জন যেন জমজ। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে নিজেও নিজেকে কিছুটা সৃষ্টি করে। পশুর সে দায় নেই। মানুষে আর পশুতে পার্থক্য মূলত শিক্ষা। নিজেকে সৃষ্টির দায়িত্ব মানুষ শিক্ষার মাধ্যমে করে থাকে। সুশিক্ষা ব্যক্তিমানুষকে সতেজ, সবল এবং সুস্থ রাখে; কে না জানে ব্যক্তিমানুষের সমষ্টিই একটি জাতি। তাই সজাগ ব্যক্তিমাত্রই শিক্ষাদান, শিক্ষা-ব্যবস্থা এবং এর প্রতিফল নিয়ে চিন্তামগ্ন থাকেন।

বইটিতে এই বিষয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা দু’টি প্রবন্ধ পাই, যদি শিক্ষা, শিক্ষক, পুস্তক, মাদ্রাসা ইত্যাদি বিষয়ে তার অনেক লেখাই আমরা অন্যত্র পাই।

একটা সময় ছিল বাঙালি মুসলমানের জ্ঞান-অর্জন মাদ্রাসায় সীমাবদ্ধ ছিল, বিশ শতকের প্রথম দিকে সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়। আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি মুসলমান বিদ্যাশিক্ষার ঠিকানা মাদ্রাসা থেকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালেয়ে পরিবর্তমুখী হয়। বাঙালি মুসলমানের সামাজিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে এই শিক্ষার সম্প্রচার ও সম্প্রসারণ চলে কয়েক যুগ। লক্ষ্য ছিল স্কুল-কলেজমুখী করা। প্রথম দিকে মানসম্পন্ন শিক্ষা থাকলেও পরবর্তীতে শিক্ষার মানহীনতার ফ্যাকাশে চেহারা পরিলক্ষিত হতে থাকে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে উঠে মানপত্র নির্ভর। ভালো, বড় মানপত্র বা সার্টিফিকেট হলে ভালো চাকুরি নিয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নতই একমাত্র লক্ষ্য পরিণত হয়। আর্থিক দৈন্যতার উপায় হয়ে উঠে শিক্ষা। পেটের তাগিদই শিক্ষার চাহিদা বাড়িয়ে তুলে, মনের তাগিদ অনুপস্থিত। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ভাষায় বলতে হয়:

“শিক্ষার দুটি আদর্শ আছে একটি প্রয়োজনের, আর একটি অপ্রয়োজনের। প্রথমটি ক্ষুদ্র আদর্শ, কেননা অর্থসমৃদ্ধির দ্বারা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করাই তার লক্ষ্য; দ্বিতীয়টি বৃহৎ, কারণ মানুষের মনোবিকাশের পথ উন্মুক্ত করে দেওয়াই তার কার্য।”

শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক মনীষীই অনেক ভালো ভালো কথা বলে গেছেন। তারমধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “তোতা কাহিনী”টি বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেই লেখাটি, তা আমরা সবাই জানি। আজও কী সেই অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়েছে? আমরা কী সেই আবর্ত থেকে নিজেদের বের করতে পেরেছি? প্রশ্নগুলো সাধারণ মানুষ থেকে বুদ্ধিজীবী সবশ্রেণির মানুষকেই ভাবিত করে। দার্শনিকদের গুরু প্লেটো মনে করতেন নগর-রাষ্ট্রে ব্যক্তির সর্বাধিক ব্যক্তিত্ব বিকাশ সম্ভব। যদিও পরবর্তীতে তাঁরই ভক্তিমান-শিষ্য এরিষ্টটল এককথায় নাকচ করে দিয়েছেন। ব্যক্তিত্ব বিকাশের সাথে নগর-রাষ্ট্রের কোন যোগ বা যোগসাজশ কোনটাই নেই।   তবে ব্যক্তিত্ব বিকাশে প্লেটোর শিক্ষা-পদ্ধতি আধুনিক দার্শনিকের অনেকে অকুন্ঠভাবে অত্যুৎকৃষ্ঠ পদ্ধতি হিসেবে অভিহিত করেছেন।

আহমদ ছফা’র ভাষায়

“মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায় না, মানুষ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতাকে অর্জন করতে শেখে।”
এই শেখার কাজটি মানুষ শিক্ষা-অর্জনের মাধ্যমে করে। সব যুগেই দেখা গেছে এই শিক্ষা-ব্যবস্থা যাঁরা নিয়ন্ত্রন করেন, তাঁরা সমাজে একধরণের কর্তৃত্ব আয়ত্ত করে থাকেন এবং নিজের সুবিধা অনুযায়ী তার প্রয়োগ করেন।

“শিক্ষার জন্য তিনটি জিনিস অপরিহার্য। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং পাঠ্যপুস্তক। এই তিনটির সাথে যদি উদ্দেশ্য যুক্ত না হয়, তবে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যটি ভণ্ডুল হয়ে যেতে বাধ্য।”

উদ্দেশ্য নিয়ে উপরে আলোচনা করা হয়েছে। আহমদ ছফা’র দৃষ্টিতে উদ্দেশ্যটি হল

“প্রতিটি শিক্ষার্থীকে বিচারশীল ও চিন্তাশীল করে গড়ে তোলা।”

তিনি আরো বলেন
 শিক্ষাদান প্রক্রিয়া থেকে এই উদ্দেশ্যটি একরকম বাদ পড়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং পাঠ্যপুস্তকওই তিনটি বিষয়ের উপস্থিতিতে থাকবে ও সেগুলো কোন কাজে আসছে না। ফ্যাক্টরি থেকে উৎপাদিত মালের পণ্যের মত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণী পাশ করা যুবক-যুবতীরা বেরিয়ে আসছে। তাদের কাছ থেকে দেশের কোন প্রত্যাশাই পূরণ হওয়ার কথা নয়। ”

নিঃসন্দেহে শিক্ষক শিক্ষা-প্রদান প্রক্রিয়া এক অবিচ্ছেদ্য অংশজ্ঞান আর বিদ্যার সঙ্গে কোনরকম সম্পর্কিত শিক্ষা আজ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যায় না। এমন অবস্থাতেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী প্রতিবছর বের হচ্ছে। তাঁদের একটি বিরাট অংশ শিক্ষকতা আর সরকারে প্রশাসন ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ করছে। এমন বিদ্যার্থীদের হাতে আজ শিক্ষকতার মত গুরুদায়িত্ব। কাজটির গুরুত্বপূর্ণতা বিবেচনা করে বলা হয়ে থাকে যে, শিক্ষকরা হলেন জাতি তৈরির কারিগর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেক বেশি পরিমাণে প্রাতিষ্ঠানিক দলাদলি এবং জাতীয় রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েছেন। শিক্ষকেরা ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করেন। ১৯৮৮ সনে লেখা প্রবন্ধে উনি নোট মুখস্ত আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করা এক মনে করে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে ছিলেন, কিন্তু আজ বাস্তবতা আরো করুণ। নকল, নোট আর শিক্ষক তোষামোদ-ই এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষা পাশের পূর্বশর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে আর নিচের ক্লাসের কথা তো বলার মতো না। আজ দেশে কোচিং-বানিজ্য সহায়ক পরীক্ষায় শিশুদের শৈশব আর কৈশোর বিস্বাদ আর মাধুর্যহীন। শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের চেয়ে প্রাইভেট পড়ানোর নামে ছোট ছোট শিশু-কিশোরদের বলির পাঠা বানাচ্ছেন। যা দেশের সর্বত্র উচুঁ-নিচু, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শহর-গ্রাম, নারী-পুরুষ সবাই এবং সবখানে একবাক্যে শিক্ষা বানিজ্যের এই কথা স্বীকার করবেনশিক্ষকেরা আজ পরীক্ষার হলে ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তর বলে দিচ্ছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস করছেন, অসৎভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের নম্বর দিয়ে পাশ করিয়ে দিচ্ছেন। সুমহান হিসেবে যে পেশাকে যুগ যুগ ধরে সম্মান জানিয়ে এসেছে সবদেশের সবকালের মানুষ, সেই পেশাই এদেশে আজ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভূলুণ্ঠিত, কলঙ্ককর, মর্যাদাহীন আর অসম্মানপূর্ণ।

শিক্ষকদের সম্পর্কে আহমদ ছফার মূল্যায়ন নিচের মত
“শিক্ষা দেয়া ছাড়া অনেক বিষয়েই তাঁদের যোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বই-পুস্তক লেখা এবং পাঠ করার পাঠ অনেকেই চুকিয়ে ফেলেছেন। ইদানিং শিক্ষকদের লেখা কিছু বইপত্রের ওপর একটি সাপ্তাহিকে একজন শিক্ষকের জরীপ জাতীয় একটি রচনা প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, দেশের অনেক প্রথিতযশা অধ্যাপক শুদ্ধ করে বাংলা বাক্যও লিখতে পারেন না। সরল ইংরেজি বাক্য নির্ভুলভাবে অনুবাদ করার যোগ্যতা অনেক শিক্ষকের নেই। দেশের শিক্ষক শ্রেণীর দীনতা এমনভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে কেউ দেখিয়ে দিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই।”

আজ শিক্ষার্থীদের নিয়ে কথা বলতে গেলে দুঃখে-কষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসে। চারিদিকে যা দেখা যায়, একজন সুস্থ মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সারাদিন যেভাবে বইয়ের বোঝা টানে, পড়াশোনার নামে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অদৃশ্য এক জেলখানাবদ্ধ থাকে,  রেসের ঘোড়া হয়ে একেকজনকে প্রথম হওয়ার প্রতিযোগীতায় নামিয়ে বাবা-মা যে তৃপ্তির ঢেকুর দেন তা নিদারূন যন্ত্রনাদায়ক। এমন ফুলের পাপড়ির মতো শিশু-কিশোরগুলোর মর্মান্তিক, কণ্টকযুক্ত শৈশব, কৈশোরগুলো প্রতিদিন এই দেশেই দেখা যায়। এই অত্যাচারগুলো পবিত্র শিক্ষার নামেই হচ্ছে। এইসব শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের কোন সুযোগই নাই, যতটুকুও বা হতে দেখা যায়, তাও অপ্রতুল।

একটি বাচ্চা শৈশব-কৈশোর পেড়িয়ে এসে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কিভাবে শিক্ষা-জীবনটা ব্যয় করে থাকে, তা যত কম বলা যাবে ততই মঙ্গল। অবস্থাটি এমন দাঁড়িয়েছে যে ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষা পাশের জন্য বই-পুস্তক পাঠ করা ছেড়ে দিয়েছেন। সব ধরনের শিক্ষার্থীরাই সাজেশন সংগ্রহ করে, সেই অনুযায়ী নোট কণ্ঠস্থ করেন।

“যে সব ছাত্র-ছাত্রী ভালোভাবে কণ্ঠস্থ করতে পারেন, তাদের পরীক্ষার ফলও সে রকম ভালো হয়। যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর মুখস্ত করার যোগ্যতা নেই, তারা পরীক্ষায় খারাপ করে থাকে।”

একটা সময়ে উপরের বর্ণিত অবস্থা ছিল, এখন তো কষ্ট করে পড়তেও হয় না। কিছু টাকার বিনিময়ে স্বল্পসময়েই দেশে মিলছে বড় বড় ডিগ্রি।

আজকের দুনিয়ায় পাঠ্যপুস্তক ছাড়া শিক্ষার সব আয়োজনই অর্থহীন। আমাদের ক্ষুদ্র শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তকের বোঝা নিয়ে দিনাতিপাত করলেও, সেই বোঝা কতটুকু তাদের জন্য যথাযথ এবিষয়ে বহু বির্তক বহুদিনের। এখানটাও বানিজ্যের অশুভ ছায়া মুক্ত নয়। অনেক বই-ই শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যসাধনে ক্ষুদে বিদ্যার্থীদের সারাবছর বয়ে বেড়াতে হয়। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সেই মান্ধাতার আমলের বইগুলো বা তাদেরই ঘষামাজা সংস্করণই জাতিকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করছে। আধুনিক এবং বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন শিক্ষা-ব্যবস্থায় সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীরা পাঠ্যবই সংগ্রহের ব্যাপারে একটা মারাত্মক সঙ্কটজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন। বছরের পর বছর ধরে এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতি এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বই লেখার পাঠ বহু আগেই চুকিয়েছেন। এখন আর কেউ পরিশ্রম করে বস্তুনিষ্ঠ, পাঠ্যোপযোগী বই লিখছেন না, যদিও বা লিখছেন, অনেকটা দায়-সাড়া গোছের বই বের হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা নেই বললেই চলে। শিক্ষকরা এখন গবেষণায় সময় ব্যয় না করে, বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো ব্যস্ত। পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজনীয়তাই আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। নোট সংগ্রহ করে মুখস্ত করেন এবং খাতায় গিয়ে অনেকটা বমি করে পরীক্ষা বৈতরণী পার হয়ে যান। বিষয়ের উপর ছাত্র-ছাত্রীদের কোন অধিকার জন্মায় না। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবিষয়ে দৃষ্টি দেওয়াকে আদৌ একটা প্রয়োজনীয় বিষয় বলে মনে করছেন না।

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের একটি সত্যিকার জ্ঞান ও বিদ্যা হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়াল। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত জ্ঞানভিত্তিক বিদ্যার বিকাশ সাধন অত্যন্ত জরুরী। আমাদের এইসব বিদ্যাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কবে নাগাদ প্রকৃত জ্ঞান বিদ্যার বিকাশকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারবে সেটা এই সমাজের একটি জিজ্ঞাসা।

আহমদ ছফার ভাষায়
“শিক্ষা-ব্যবস্থার দীনতা আমাদের জাতীয় জীবনের সামূহিক অবক্ষয়ের জন্য দায়ী না কি রাজনৈতিক বিপর্যয় আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থাকে এই পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখার বিষয়।”

প্রশ্নটি আজ ছাত্র-শিক্ষক, অভিবাবক-কর্তৃপক্ষ, সরকার-জনগন সবার কাছেই। এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবাইকে খুঁজে পেতে হবে। আমরা শিক্ষাকে নিয়ে এমন খেলায় কেন মেতে আছি? এতে জাতির কী উপকার হচ্ছে, কতটুকু প্রয়োজনীয়তা আছে এমন শিক্ষা-ব্যবস্থার। একদিনে হয়তো আমূল পাল্টে ফেলা যাবে না, তবে জিজ্ঞাসা করার মাধ্যমে আস্তে আস্তে এই ব্যবস্থাকে ভেংগে গড়ে তুলতে হবে। যা অনেক বিবেকবানের মতো আহমদ ছফাও উনার লেখনী দিয়ে আমাদের মন ও মননকে তাড়িত করতে চেষ্টা করেছে।

ছকবাঁধা, গৎবাঁধা, যান্ত্রিক বুলি বা বাহ বাহ কুড়ানো সাহিত্য-চর্চা আহমেদ ছফা কোনদিন করেন নি; পছন্দ করতেন বলেও জানা যায় না। সমাজের আনন্দ-নিরানন্দ, সুখ-দুঃখ, উচিৎ-অনুচিত সবই তাঁর লেখায় পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা সবসময় লেখাগুলো সময়ের দাবী পূরণ করেছে। লেখায় বিষয় উপস্থাপনের আগে এলাহি আয়োজনে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া, বিচারের নামে শ্বাসরোধ হয়ে যাওয়া বা সিদ্ধান্তে পৌঁছনো আগে ধোঁয়াশা সৃষ্টি সাহিত্যে নৈমিত্তিক ব্যাপার, সেখানে তাঁর লেখায় এর সবকিছুই অনুপস্থিত। সহজ-সরল নির্মেদ ভাষায় সুস্পষ্ট, সুপরিমিত এবং সুবিন্যাস্ত উপস্থাপনের এক বিশেষ ক্ষমতা লেখাগুলোয় দেখা যায়। প্রবন্ধের বিষয়গুলো শব্দে শব্দে ওজনদার, ফুলে-ফেঁপে বিরাটাকার বা ভাষার মায়াজালে ঝাঁপসা হয় না।

‘সেইসব লেখা’ বইটিতে প্রবন্ধ সংখ্যার মতো, প্রবন্ধের বিষয়ও বহু। স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতি, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক, বেগম রোকেয়া, জ্যোতির্ময়গুহ ঠাকুরতা, কবি ফররুখ আহমেদ থেকে শুরু করে বহু বিষয়ের অবতারণা করে লেখা প্রবন্ধের এক বিশাল সমাবেশ এই বইয়ে হয়েছে। লেখার শুরুতেই বলেছি, সব বিষয়ে সবার বলার ক্ষমতা থাকে না, আর থাকলেও সব বিষয়ে বলতে নেই। তাই যেসব বিষয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হয়, তা নিয়েই দু’চার কথা বলার চেষ্টা; বলা যেতে পারে বোঝার চেষ্টা করেছি মাত্র। এই লেখায় মাধ্যমে আহমদ ছফা’র মতো উচ্চকোটির মানুষের কোন কমা-বাড়া হবে না, তিনি বাঙালির হৃদয়ে যেভাবে স্থান করে নিয়েছেন তা অক্ষয়, অমর হয়ে থাকবে বহুদিন।



(লেখাটি গল্পকথা'র ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় প্রকাশিত)