আজ

পড়া বইয়ের কথা -২

ঐতিহাসিকের নোটবুক— সিরাজুল ইসলাম

এমরান হোসেন রাসেল©

ইতিহাস একটি জটিল বিষয় এবং নিরপেক্ষ ইতিহাস এক অলীক বস্তু। যার সবচেয়ে প্রামাণ্য দলিলগুলো ভূগর্ভে নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে রয়েছে। সেগুলোকে খুঁচিয়ে বের করতে হয়। কম-বেশি সব ইতিহাসই কোন-না-কোন প্রভাবে স্ফীত বা সংকুচিত। একমাত্র সুক্ষ্ম বিবেচনার অধিকারী মস্তিস্ক এবং দক্ষ আর অভিজ্ঞ হাতেই সত্য ইতিহাস উন্মোচিত হয়।



‘ঐতিহাসিকের নোটবুক’—লেখক সিরাজুল ইসলাম
গ্রন্থটি ২০১০ সালে প্রথম, ২০১৩ সালে দ্বিতীয়বার কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়
২৫০ টাকার ২০৬ পৃষ্ঠার গ্রন্থটিতে বাইশটি প্রবন্ধের সম্মিলন ঘটেছে।
বিনিময় মূল্যে সার্থক একটি গ্রন্থ; ইতিহাসের সত্যানুসন্ধানী পাঠক মনে গ্রন্থটির মূল্য আরো অনেক বেশি।


লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক (১৯৬৬-২০০০), প্রধান সম্পাদক— বাংলাপিডিয়া, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি (তিনবার)। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৬৮ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দি স্কুল অব অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ বিভাগে অধ্যয়ন করেন এবং ১৯৭২ সালের প্রথমদিকে “বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত” শীর্ষক গবেষণা কর্মের উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। গবেষণা কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ড. সিরাজুল ইসলাম সিনিয়র ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকার ইলিয়ন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।


ইতিহাসের শক্ত, জটিল, দুরূহ বা অনুজ্বল তথ্যের ঘনঘটা নেই, প্রতিটি প্রবন্ধ অনেকটা গল্পচ্ছলে বর্ণিত। প্রকাশ ভঙ্গি হালকা হলেও নির্বাচিত বিষয়সমূহ কোনভাবেই হালকা নয়, বরং প্রতিটি প্রবন্ধ নির্ভরযোগ্য সূত্র অবলম্বন করে লেখা তাই সত্যান্বষী পাঠককে গভীর চিন্তার খোরাক দেবে।


প্রবন্ধগুলো বিষয় বৈচিত্রে অনন্য। যেমন : যে প্রবন্ধের নামে গ্রন্থটির নামকরণ অর্থাৎ ঐতিহাসিকের নোটবুক—এর কথাই বলি। তাতে অনেকগুলো মনোমুগ্ধকর বিষয়ের স্বল্প কথায় ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা লেখক করেছেন; বলা যেতে পারে কয়েকটি টীকা নিয়ে প্রবন্ধটি। যেমন:

ক) যাদের উত্তরসুরী ‘একুশে’—এ জানা যায়, ১৯১৩ সালে বগুড়ার বেনিয়াপাড়ায়  বাংলার আলেম-ওলামাগণ এক সম্মেলনে আঞ্জুমান-ই-উলামা-ই-বাঙ্গালা নামের এক সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেন। লক্ষ্য ছিল মুসলমান সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করা। তাঁদের মুখপাত্র ‘আল-এসলাম’ আর এর দায়িত্ব ছিল চারটি মূলনীতি প্রচার করা— স্বদেশ, স্বধর্ম, স্বজাতি ও মাতৃভাষা। পাঠ শিল্পকে কেন্দ্র করে সেই সময় বাঙালি মুসলমানের মধ্যে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে। কিন্তু প্রভাবশালী উর্দূপন্থী মোল্লারা ফতোয়া জারি করে, বাংলা-ভাষা চর্চাকারী মুসলমান, ধর্ম থেকে খারিজ হয়ে যাবে, এমনকি ‘বিবি’ তালাক হয়ে যাবে এবং সন্তানরা হবে জারজ। এইসব বিষয়ে প্রতিবাদী হয়ে ‘আল-এসলাম’ অনেক লেখা ছাপেন। লেখক বিভিন্ন সূত্র উল্লেখ করে এদেরকে ভাষা-আন্দোলনের পূর্বসুরী বলেছেন।

খ) মিষ্টি ও গন্ধবণিক— আর্য যুগ থেকেই ভারতীয়রা গরুর দুধ বা দুধ থেকে তৈরি ক্ষীর বা দই খেয়েছে। কিন্তু দুধ ভেঙে ছানা বানিয়ে, ছানা কে শত রকমের মিষ্টির উপাদান হিসেবে ব্যবহার তারা জানতো না। দুধের এই ছানা তৈরি করে যাবতীয় ব্যবহারের পুরো কৃতিত্ব নাকি পর্তুগিজদের। ভারতীয় নিরামিষ সাংস্কৃতিক সমাজে আচার-চাটনি জাতীয় খাবারের ব্যবসা করেও পর্তুগিজরা অকল্পনীয় মুনাফা অর্জন করেছিল। এদের বিদায়ের পর বাঙালিরা পর্তুগিজ পদ্ধতি অবলম্বন করে মিষ্টি বানানো শুরু করে, সমাজে সৃষ্টি হয় গন্ধবণিক মানে এক বর্ণভিত্তিক ময়রাশ্রেণি, ময়রারা কিছুদিন আগে আমাদের সমাজে এক অবিচ্ছেদ্য শ্রেণি ছিল।

আরেকটি প্রবন্ধ, ‘শায়েস্তা খাঁর এক টাকা’— আমরা সস্তা বোঝাতে শায়েস্তা খাঁর আমলকে উদাহরণে টানি। কিন্তু এর বিপরীত দিকটি নিয়ে কেউ কোনদিন ভেবেছি কি? লেখক তা সুন্দরকরে তৎকালীন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখিয়েছেন বিষয়টি আসলে কতটুকু মধুর বা তিক্তের!

‘বিলেতে শেখ দীন মোহাম্মদ(১৭৮৩-১৮৫১)’— যদি প্রশ্ন করা হয় ভারতীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম কে ব্রিটিশ পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা করেন? কোন ভারতীয় যিনি ইংরেজি ভাষায় প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন? ভারতীয়দের মধ্যে কে প্রথম ব্রিটিশ মেয়ে বিয়ে করে? ভারতীয়দের মধ্যে কে প্রথম রেস্তোরাঁ ব্যবসা শুরু করেন? ভারতীয় চেম্পোকে কে প্রথম আধুনিক বিশ্বে শেম্পোতে রূপান্তর করেন। এমন সব চিত্তাকর্ষক প্রশ্নের উত্তর বিস্তারিত হয়েছে প্রবন্ধটিতে।

‘আমাদের হক সাহেব’ প্রবন্ধটিতে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক-কে এক নতুন মাত্রায় ভাববার প্রয়াস দেখা যায়। সারা জীবন একটি অস্থিরতায় তিনি রাজনীতি করে গেছেন, কোন দলেই তিনি দু’তিন বছর, এমনকি নিজ দলেও তিনি স্থায়ী ছিলেন না। কেন? প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ও পরে তিনি বারবার প্রাথমিক শিক্ষা ফ্রি করবেন বলেও কেন ব্যর্থ হলেন। ১৯১৩ সালে রাজনীতিতে যোগদান করে মাত্র চার বছরের মধ্যে তিনি মুসলিম লীগ আর কংগ্রেস উভয় দলের শীর্ষ নেতায় পরিনত হন অথচ ১৯২৫ থেকে ১৯৩৪ সালে একবারেই ম্লান। শেরে বাংলাকে নিয়ে অনেক মিথ যে ভুল লেখক ঐতিহাসিক প্রমাণ আর যৌক্তিক ব্যাখ্যায় তা বলতে চেষ্টা করেছেন। যা প্রকাশের পর দেশের একটি মহল সহ্য করতে পারেনি এবং বেশ গণ্ডগোলের পর লেখককে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।

‘মার্কিন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : মিল অমিল’— প্রবন্ধটিতে দু’দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যে অনেক মিল যেমন : উভয় যুদ্ধের আগে তরুন সমাজের কর্মকাণ্ড, উভয় দেশ হাজার মাইল দূরের শাসকদের সাথে এক অসম যুদ্ধে জয় লাভ করে, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করেন উভয় দেশে— এমন আরো অনেক চমকপ্রদ এবং সত্যনিষ্ঠ তথ্যের সংযোগে প্রবন্ধটি মান বজায় রেখেছে।

গ্রন্থটির একটি নির্দিষ্ট প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করতে চাই। উনিশ শতকের আটের দশকে ‘বিচিত্রায়’ লেখাটি প্রকাশের পর বেশ সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।


পূর্ববঙ্গের অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকার নবার পরিবার নিয়ে বোধহয় পর্যাপ্ত লেখাজোখার বড় অভাব। কালের ইতিহাসের পথ-রাজপথ খোঁড়াখুঁড়ি করলে ঢাকার নবাবদের যে ইতিহাস পাওয়া যায় তা অনেকটা রোমাঞ্চকর। এই বংশের উত্থান এবং পতনকে লেখক দু’টি সরকারি নিলাম দিয়ে সীমা নির্ধারণ করেছেন। নিলাম দু’টির মধ্যে সময়ের ব্যবধান এক শতাব্দীর অর্থাৎ একশ’ বছর।

নবাব আলীবর্দী খানের রাজত্বকাল। ভাগ্যহত আবদাল (আবদুল) হাকিমের আদিবাসস্থান কাশ্মীর। তিনি পূর্বাঞ্চলের বহু জেলা জনপদ ঘুরে সিলেটে স্থায়ী হোন, ব্যবসা ছিল চামড়ার। হিন্দুরা ধর্মীয় কারণে চামড়া ব্যবসা করত না, তাদের অনুকরণে স্থানীয় মুসলমানেরাও এই ব্যবসা করতো না বা স্থানীয় মুসলমানের পুঁজি ছিল না। তাই এ ব্যবসায় একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল হিন্দুস্থানী মুর বা অবাঙালি মুসলমানের। অল্পসময়েই আবদাল (আবদুল) হাকিম ব্যবসায় বেশ লাভ করেন, এবং নিজের ছোট ভাই আবদুল্লাহকে কাছে নিয়ে আসেন। ছোটভাই ছিল আরো দূরদর্শী, সে বুঝতে পারলো ব্যবসায় আসল স্থান হলো ঢাকা। পসার জমাতে হলে সেখানে যেতে হবে। আব্দুল্লাহ ১৭৮০ সালে ব্যবসার উদ্দেশ্যে ঢাকা চলে আসেন। ইংরেজ সান্নিধ্যে ব্যবসায় অধিক মুনাফা সম্ভব, যা আবদুল্লাহ জীবদ্দশায় সম্ভব হয়নি। আবদুল্লাহ ১৭৯৬ সালে মারা যান; ছেলে হাফিজুল্লাহ কয়েকজন আর্মেনীয়ের সাথে লবনের ঠিকাদারীর যৌথ ব্যবসা শুরু করেন। আর্মেনীয়দের নাম ছিল কোজা জোহানেস, কোজা ডাকোস্তা এবং কোজা মাইকেল, আর্মেনীয় প্রত্যেকের নামের শুরুতে ছিল ‘কোজা’ এবং হাফিজুল্লাহ নিজেও নামের আগে ‘কোজা’ ব্যবহার করা শুরু করেন, এই ‘কোজা’-ই পরে ‘খাজা’-য় রূপান্তরিত হয়।

যে হীরাটি তাকে জহরত জগতে বিখ্যাত করেছে সেটা—দরিয়া-ই-নুর বা আলোর সাগর। সবকিছুর পরও খাজা আলীমুল্লাহের আভিজাত্যের দু’তিনটি উপকরণের অভাব ছিল, যা তাঁর ছেলে খাজা আবদুল গণি পূরণ করেন।

লবনের ঠিকাদারী কাজে হাফিজুল্লাহ প্রায়ই বাকেরগঞ্জ (বরিশাল) যেতেন, সেখানকার দক্ষিণ শাহবাজপুর (ভোলা) ও রমনা-বমনা ছিল লবন তৈরির বড় কেন্দ্র। ১৮১২ সালের জানুয়ারি মাসে হাফিজুল্লাহ ব্যবসায়ী দরকারে রমনা-বমনায় কোজা মাইকেলের দেখা করতে যান। একদিন সন্ধ্যা খাওয়া-দাওয়ার পর খোশ-গল্পে কোজা মাইকেল হাফিজুল্লাকে জমিদারি ক্রয় করতে বলেন। এদিকে হাফিজুল্লাহর ব্যবসায়ও তেমন একটা সুবিধা হচ্ছিল না। সবদিক বিবেচনা করে হাফিজুল্লাহ সিদ্ধান্ত নেন, তিনিও জমিদারী কিনবেন। পরের সপ্তাহেই সুযোগ হলো। কালেক্টর বেটি’র নিলামে প্রায় ৪০ বর্গ মাইল এলাকা নিয়ে দু’টি অনুন্নত পরগনা ‘আয়লা টিয়ারখালী’ ও ‘ফুলঝুড়ি’ মাত্র ২১ হাজার টাকায় কিনে নেন, যার বাৎসরিক সরকারী জমা মাত্র ৩৭৮ সিক্কা টাকা। তাঁর ভাগ্য ভালো ছিল, কেনার কিছুদিনের মধ্যে প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটে এবং সব প্রতিকূলতা দূর হয়ে পরগনা দু’টি লাভজনক হয়ে উঠে১৮২০ সালে জমিদারি থেকে আয় করে প্রায় এক লক্ষ টাকা।

খাজা হাফিজুল্লাহ ছিলেন নিঃসন্তান, মৃত্যুর পর ছোটভাই আলীমুল্লাহ কর্তৃত্ব পান। খাজা আলীমুল্লাহ-ও দূরদর্শী ছিলেন১৮২৫ থেকে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত খাজা আলীমুল্লাহ আরো জমিদারি কিনে পূর্ববঙ্গের বৃহত্তম জমিদার বনে যান। ঢাকা, বাকেরগঞ্জ, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ জেলায় বিস্তৃত তাঁর প্রকাণ্ড জমিদারী। জমি, জমিদারী আর টাকা-পয়সার পর আলীমুল্লাহকে আভিজাত্যের নেশায় পেয়ে বসে আভিজাত্যের ঘরে কড়া নাড়তে ১৮৩১ সালের জানুয়ারি মাসে লাহোরের বিখ্যাত ঘোড়া সরবরাহকারী জবরদস্ত খানকে দিয়ে ১২টি উচ্চ জাতের আরব্য ঘোড়া আনেন এবং পুরো ঢাকায় ঘোড়ার প্রদর্শণী করান। তিনি ঢাকায় প্রথম সাপ্তাহিক ঘোড়দৌড়ের ব্যবস্থা করেন। তার সবচেয়ে অভিজাত নেশা ছিল হীরা-জহরতের অলঙ্কার পরা। যে হীরাটি তাকে জহরত জগতে বিখ্যাত করেছে সেটা—দরিয়া-ই-নুর বা আলোর সাগর। সবকিছুর পরও খাজা আলীমুল্লাহের আভিজাত্যের দু’তিনটি উপকরণের অভাব ছিল, যা তাঁর ছেলে খাজা আবদুল গণি পূরণ করেন।

খাজা আলীমুল্লাহর পর তাঁর ছেলে খাজা­ আবদুল গণি আভিজাত্যের ষোলকলা পূর্ণ করেন দান আর দরবার বসিয়েখাজা আবদুল গণির একটি বিশেষ ক্ষমতা ছিল— সালিশের মাধ্যমে বিবাদ-বিসম্বাদ মিটমাট করা। ১৮৬১ খ্রি. খাজা আবদুল গনিকে অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত করা হয়। ১৮৬৯ সালে শিয়া-সুন্নী সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিলে সরকার মীমাংসায় ব্যর্থ হয়ে খাজা আবদুল গণির হস্তক্ষেপ কামনা করলে, তিনি তিনদিনের মধ্যে দাঙ্গা বন্ধ করতে সক্ষম হন। দাঙ্গা শুধু বন্ধই হয়নি পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে ঢাকায় এমন আর কোন ঘটনা ঘটেনি। সে সালিশে তিনি বিশ হাজার মানুষকে চারদিন পর্যন্ত খাওয়ান। এই সফলতায় সরকার তাকে কোম্পেয়িন অব দি অর্ডার অব দি ষ্টার অব ইন্ডিয়া (সি.এস.আই) পদবিতে ভূষিত করেন।

নবাব খাজা আবদুল গণি

খাজা আবদুল গণি’র ক্ষমতাহরণের মাত্র তিন বছর পর সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। সিপাহী বিদ্রোহের সময় প্রতিদিন ঢাকার যুব সমাজ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে দরবার বসিয়ে ‘ইংরেজ রাজত্ব আল্লাহর আর্শীবাদ’ বোঝাতেন। ১৮৭৫ সালে ব্যক্তিগতভাবে ‘নবাব বাহাদুর’ উপাধি দিয়ে খাজা আবদুল গণিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিজাত শ্রেণির সদস্যভুক্ত করা হয়, যা দু’বছর পর ১৮৭৭ সালে ব্যক্তিগত উপাধি’র বদলে বংশানুক্রমিক নবাব উপাধি দিয়ে গোটা খাজা পরিবারকে অভিজাত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮৮৬ সালে তাঁকে কে.সি.এস.আই এবং ১৮৯২ সালে নওয়াব বাহাদুর উপাধি দেওয়া হয়। উনবিংশ শতকে বাংলাদেশের অন্য কোনো নেতাই সরকার ও জনগণ উভয় মহল থেকে এত সম্মান, প্রশংসা লাভ করতে পারেনি।

খাজা পরিবার অর্থাৎ ঢাকার নবাবদের খাজা (কোজা) হাফিজুল্লাহ দিয়ে গোড়াপত্তন, তাতে খাজা আলিমুল্লাহর গতি সঞ্চার আর খাজা আবদুল গণির অদম্য গতি খাজা (কোজা) পরিবারকে সাড়া ভারতবর্ষে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। ধরা যায় পরিবারটির গৌরবের রবি মধ্যরেখা অতিক্রম করছিল। 

খাজা আবদুল গণি প্রচুর দান-দক্ষিণা করেছেন। ঢাকা প্রকাশ-এ এক তালিকায় ধর্মীয় দান-দক্ষিণা বাদে শুধুমাত্র উনিশ শতকে সত্তর দশকে জনকল্যাণমূলক দানের পরিমাণ তিন লক্ষ পঁচিশ হাজার পাঁচ শত টাকা উল্লেখ পাওয়া যায়।

১৮৭৭ সালে নওয়াব আহসানউল্লাহ পিতা খাজা আবদুল গণির জীবদ্দশায়ই গদিসীন হন। ১৮৮৫ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন পাস হওয়ার আগে পর্যন্ত মাটিতে প্রজার কোনো অধিকার ছিল না, জমিদাররা নিজ মর্জি মতো খাজনা বৃদ্ধি করতে পারতো। এই আইনের ফলে জমিদারের ক্ষমতা যথেষ্ট সীমিত হয়ে পড়ে, আয় হ্রাস পায়; অপরদিকে নবাব পরিবারের সদস্য সংখ্যা, শানশওকত ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং রাজনীতিতে যোগদান ইত্যাদি কারণে ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। ফলে আয়ের ঘাটতির শুরুটা এখানে থেকেই ধরা যেতে পারে। খাজা আবদুল গণি মৃত্যুর আগে পুত্র নওয়াব আহসানউল্লাহর ঋণ করতে দেখে যান। আক্ষেপও করেন মহারাণী ভবানীর মতো— লক্ষ লক্ষ টাকা বিভিন্ন ফান্ডে দান না করে যদি ব্যবসা বা জমিদারিতে সদ্ব্যবহার করতেন তবে তাঁর পরিবারের এই দূর্দিন নিজের চোখে দেখে যেতে হতো না।

নবাব আহসানউল্লাহকে লেখক উপেক্ষা করে গেছেন। মাত্র একটি বাক্যে “নবাব আহসানউল্লাহ টানাপোড়েন অবস্থায় কোনো মতে চলে যান” তিনি আহসানউল্লাহর কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ করেছেন। এরপরই তিনি নবাব সলিমুল্লাহ’য় চলে গেছেন। অথচ নবার আহসানউল্লার কর্মকাণ্ড উপেক্ষণীয় নয়। ব্রিটিশ সরকার নওয়াব আহসানুল্লাহকে ১৮৭১ খ্রি. খান বাহাদুর, ১৮৭৭ খ্রি. নওয়াব, ১৮৯১ খ্রি. সি.আই.ই, ১৮৯২ খ্রি. নওয়াব বাহাদুর এবং ১৮৯৭ খ্রি. কে.সি.আই.ই. খেতাব প্রদান করেন। তিনি ১৮৯০ এবং ১৮৯৯ খ্রি. বড়লাট আইন সভায় সদস্য হন। গোবিন্দপুর পরগনা ক্রয় করে জমিদারি বিস্তৃতি ঘটান কী করে! ইতিহাসের সাধারণ পাঠক হিসেবে মনে একটি প্রশ্ন জাগে ঋণগ্রস্থ নবাব আহসানউল্লাহ নিজ ব্যবস্থাপনায় কী করে ব্যক্তিগত উন্নতি আর জমিদারি’র বিস্তৃতি ঘটান!

‘রাজত্ব, রাজনীতি, ক্ষমতা এসব যে শত বছরের স্বপ্ন মাত্র।’  লিও টলস্টয়

যাক সে কথা, ১৯০৬ ব্রিটিশের ইঙ্গিতে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়; মুসলিম লীগের পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের নেতৃত্ব দেন নবাব খাজা সলিমুল্লাহ। ঘাটতি আয়ের জমিদারি থেকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা এবং বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের প্রতিরোধ করতে নবাব সলিমুল্লাহ প্রায় চৌদ্দ লক্ষ টাকা ঋণ করেন। ঋণ দানকারী সব মহাজন ছিল হিন্দু। ঋণদানকারী হিন্দু মহাজনেরা তাঁর উপর চাপ সৃষ্টি করে, তিনি যেন বঙ্গভঙ্গ সপক্ষে আন্দোলন না করেন,  নাহলে ঋণ আদায়ে আদালতে ডিক্রির মাধ্যমে তাঁর জমিদারি নিলামে পাঠিয়ে স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি বিক্রি করিয়ে জেলে পাঠানো হবে। ঋণের পরিমাণ সম্পত্তির মূল্যের তুলনায় ঢের বেশি ছিল। এমন সময় সুযোগ সন্ধানী ব্রিটিশ সরকার এগিয়ে এলো সলিমুল্লাহকে সাহায্য করতে। ১৯০৭ সালে এক গুপ্তবৈঠকে ব্রিটিশ সরকার সহজ শর্তে চৌদ্দ লক্ষ টাকা ঋণ দিতে রাজী হলো। শর্ত একটাই নবাব সলিমুল্লাহকে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে মুসলমান সমাজে জনমত গড়ে তুলতে হবে। ঋণমুক্ত সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গের পক্ষে দুর্বার আন্দোলন শুরু করলেন কিন্তু বঙ্গভঙ্গ বিরোধী কংগ্রেস ভারতব্যাপী বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে মহাআন্দোলন শুরু করে। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়। নিরুপায় সলিমুল্লাহ স্থবির হয়ে পড়লেন। পূর্ববঙ্গের মুসলমান নেতৃবৃন্দরা ব্রিটিশদের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদ করার জন্য তার উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছেন কিন্তু তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কিছুই বলতে পারছেন না; নতুন মহাজন ব্রিটিশ বেনে ব্রাহ্মণের চেয়ে অধম। এমন অবস্থায় একমাত্র উপায় হলো কিছুকালের জন্য ঘোরতরভাবে অসুস্থ হয়ে বাইরের লোকের সাথে দেখা না করা। তাই করা হলো। ১৯১৩ সালে কোলকাতায় যুক্তবঙ্গের প্রথম অধিবেশনে যোগদান করতে সরকারের সেক্রেটারি জে.এইচ. সিরার নবাব সলিমুল্লাহকে পত্র পাঠান। জবাবে তিনি অসুস্থ এবং কোলকাতায় দীর্ঘ বসবাসের মতো তাঁর যথেষ্ট টাকা নেই জানালে— সরকার তার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবে জানায়। সলিমুল্লাহ বাধ্য হলেন যেতে কিন্তু সরকারের খরচে নয়, নিজের খরচে। সাঙ্গপাঙ্গ কর্মীবৃন্দের জন্য  মাসিক কমপক্ষে বিশ হাজার টাকা খরচ তাঁর লাগবে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জমিদারির হাজীগঞ্জের মহল নিলামে বিক্রি করবেন। ১৯১৩ সালের জানুয়ারি মাস। ঢাকায় নিলাম। নিলামে সর্বোচ্চ ডাক দেয় ইস্টার্ন রেলওয়ে। সত্তর হাজার টাকা। পূর্ণ হলো ইতিহাসের ষোলোকলা।

নবাব খাজা সলিমুল্লাহ

ঠিক শত বছর আগে এমনই এক শীতে খাজা হাফিজুল্লাহ লবণ, গাঁজা ব্যবসা ছেড়ে জমিদারি ক্রয় করেছিলেন, সেবার ক্রেতা খাজা পরিবার আর বিক্রেতা সরকার। এবার ক্রেতা সরকার আর বিক্রেতা খাজা পরিবার। মধ্যখানে শত বছরে দেখতে পাই আলীমুল্লাহর ঘোড়া, হীরামুক্তা, গণির আহসান মঞ্জিল, দান ও দরবার, বিশাল ঋণ নিয়ে সলিমুল্লাহর মৃত্যু (১৯১৫)।

প্রবন্ধটি স্বল্প পরিসরে ঢাকার নবাবদের একটি ঠিকুজি বলা যেতে পারে। এত অল্প পরিসরে একটি পরিবারের ১০০ বছরের ইতিহাস বলা না, আরো অনেক কথাই না বলা থেকে যায়। আর যদি হয় পরিবারটি হয় একটি জমিদারী পরিবার তবে তার মধ্যে আরো বহু মচমচে, কুড়মুড়ে রসদ থেকে যায়— তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লেখক যে উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছেন অর্থাৎ দু’টি নিলাম— একটি পরিবারটির উঠতি আর একটি দিয়ে পরতি, তারমধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে ইতিহাসটি পরিস্ফুটিত করতে যা যা করার করেছেন। পরিবারটির উঠতি নিলামের পর অনেককিছু্ই বলা হয়েছে, হয়তো প্রয়োজনে— পরতি নিলামে যেতে হবে বলে। কিন্তু এই পরিবারের শেষ নবাবটি নবাব সলিমুল্লাহ’র পুত্র নবাব হাবিবুল্লাহ ১৯৫৮ সালের ২১শে নভেম্বর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। এর আগে অবশ্য ১৯৫২ সালের ১৪শে এপ্রিল পাকিস্তান সরকার জমিদারি উচ্ছেদ আইনে ঢাকা নওয়াব এস্টেট অধিগ্রহণ করেন।

লিও টলস্টয় যে উক্তিটি দিয়ে প্রবন্ধকার লেখাটি শেষ করেছেন আমিও একি উক্তি দিয়েই শেষ করছি 

                ‘রাজত্ব, রাজনীতি, ক্ষমতা এসব যে শত বছরের স্বপ্ন মাত্র।’

সহায়ক :

১/ ঐতিহাসিকের নোটবুক।
২/ বাংলাপিডিয়া।
৩/ নবাবদের চিত্রসমূহ উইকিপিডিয়া।