আমার
মতে প্রশ্নটি এতই অবিশেষ যে ভিন্ন ভিন্ন সাহিত্যিকের কাছ থেকে তার বিভিন্ন উত্তর
থেকে লেখা সম্বন্ধে কোনো মূল্যবান সিদ্ধান্তে আসা যায় না। যখন উদ্দেশ্যটা
নিশ্চয়ই সাহিত্যিক, ব্যক্তিগত জীবনের গোপন খবর জানা নয়, তখন প্রশ্নের
রূপ অন্যপ্রকারের হওয়াই ভালো ছিল; এই যেমন, ঐ রচনাটি অন্যভাবে না সাজিয়ে কেন এইভাবেই সাজালেন, কিংবা কেমন
করে আপনার বক্তব্যটি এই বিশেষ রূপটি পেল?
অর্থাৎ, আমার মতে why-এর বদলে how-এর দিকে ঝোঁক
দিলেই সমালোচনার পক্ষে সুবিধা হতো। আর প্রশ্নটির অন্তরালে একটা দার্শনিক মন উকি
দিচ্ছে—সেটা বোধহয় ঠিক প্রগতিশীল সাহিত্যের উপযোগী নয়। কেন, কেন, কেন, কেন এই জীবন
ধারণ, কেন এই সাহিত্যের নেশা... ?
নিতান্ত ভারতীয়, নিতান্ত
মধ্যযুগীয়, নিতান্ত হিন্দু...নয় কি? তার চেয়ে কোন মানসিক প্রক্রিয়ায় বিষ্ণু দে ‘জন্মাষ্টমী’ লেখেন, প্রেমেন মিত্র
গল্প খাড়া করেন, মানিক বন্দোপাধ্যায় তাঁর গল্পের কাঠামো গড়ে তোলেন যদি
জিজ্ঞাসা করা হতো, এবং তাঁরা ভেবেচিন্তে উত্তর দিতেন। তবে আমার মতো শিক্ষার্থী
সাহিত্যিকের কল্যাণ হতো।
তাছাড়া, এই প্রশ্নের
উত্তর কখনও honest হতে পারে না।
তার কারণ এই যে ঐ ‘কেন’র গোটাকয়েক বাঁধা উত্তর আছে যে-সব উত্তর আবার তার
সুপরিচিত সাহিত্যিক মতবাদের সঙ্গে নিতান্ত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আমরা এ মতবাদগুলি
ছাত্রাবস্থা থেকেই জানি, অতএব সেগুলি আমাদের মনে একপ্রকার সংস্কারে পরিণত হয়েছে, এবং তাদের হাত
থেকে পরিত্রাণ পাওয়া শক্ত। আমরা নানা কারণে লোকের কাছে প্রমাণিত হতে চাই যে আমরা
এই দলের না ঐ দলের, অতএব না-তলিয়ে দেখেই আমরা প্রশ্নটির বিশিষ্ট দলের সহজ
বিশ্বাসপ্রসূত উত্তরই দিয়ে থাকি, এবং দিতেই থাকব। দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। আমরা পড়েছি যে
সাহিত্যে তিনটি স্কুল আছে: ক্লাসিসিজম,
রোমান্টিসিজম, রিয়ালিজম।
ক্লাসিসিজিমে ‘কেন লিখি'র উত্তর শৃঙ্খলার আবিষ্কার, রোমান্টিসিজমের হলো প্রেরণা, ভাব ইত্যাদি
এবং রিয়ালিজমের উত্তর পর্যবেক্ষণ, পূর্ণদৃষ্টি ইত্যাদি। তাছাড়া সোশিয়ালিস্ট স্কুল উঠেছে
যার বর্তমান ঝোঁক রিয়ালিজমের দিকে । এখন কোনো লেখক যদি নিজেকে সোশিয়ালিস্ট
প্রতিপন্ন করতে চান তবে তাঁর উত্তর কী হবে ভাবা খুব শক্ত নয়; তিনি বলবেন যে
তিনি লেখেন সব চোখটা খুলে যাতে দুঃখ-দৈন্য ধরা পড়ে, তার কারণ সুস্পষ্ট হয়, সেই কারণ, সেই রীতিনীতি
বুঝে যেন সৰ্বসাধারণের (অর্থাৎ পাঠক-পাঠিকা যাঁরা জনগণ) যেন দুঃখ-দৈন্যের নাগপাশ
থেকে নিষ্কৃতি পায়, শ্রেণীর অত্যাচার বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো তাঁদের ভাষা অন্য
হবে কিন্তু দাঁড়ায় তাই। ‘কেন’র উত্তর সর্বত্রই বাঁধা বুলিতে জড়িয়ে পড়ে। একাধারে তৈরি
থিওরি, অন্যধারে pose—দুটোর মাঝে
কেন, কেন, কেন বঙ্কিমী সুরে কাঁদতে থাকে।
তবে
অবশ্য একটা কথা উঠতে পারে। কেনই বা প্রশ্নটি ব্যক্তিগত হবে না? সাহিত্য তো
সাহিত্যিকেরই একপ্রকার ব্যবহার। কেনই বা সাহিত্যসমালোচনা একপ্রকার ডিটেকটিভগিরি
হবে না? মহা মহারথীরা সাহিত্যের নামে ঐ কাজই তো করছেন। এডমন্ড উইলসন-এর ডিকেন্সের
আলোচনা একপ্রকারের ক্রিমিন্যাল ইনভেস্টিগেশন। আমি এর উত্তর দিতে আপাতত অক্ষম।
সেইজন্য বাক্যব্যয় না করে খোলাখুলি লিখছি ;
কেন লিখি?
ইংরেজি
বই ও প্ৰবন্ধ লিখেছি তার প্রধান কারণ চাকরি বজায় রাখা । বাবা যে টাকা রেখেছিলেন
সেটা তিন পার্সেন্টের বদলে ছয় পার্সেন্ট থাকলে ইংরেজিতে কোনো বই লেখার প্রয়োজন
হতো বলে মনে হয় না | প্ৰথম, ইংরেজি বই লেখার উৎস ছিল কর্তৃপক্ষের শ্লেষ : ধূর্জটি
সংগীত আর সাহিত্য নিয়েই (অর্থাৎ ফাজলামি করেই) কাটালে, কাজের মতো কাজ
করলে না। শ্লেষের উত্তরে শ-দুই-তিন বই ঘেঁটে এবং তাদের উল্লেখ দিয়ে বই লিখলাম।
এবং লিখে পৃথিবীর জন-দশেক মাথাওয়ালা লোকের কাছে পাঠালাম। তাঁদের চিঠিতে
আত্মবিশ্বাস এল। চিঠিগুলো কর্তৃপক্ষকে গোপনে দেখিয়েছিলাম। তখন বয়স ছিল কম, তাই ঔদ্ধত্য
একটু বেশিই ছিল। কিন্তু খবরের কাগজে ছাপাবার লোভ সংবরণ করবার মতো ব্ৰাহ্মণ্যও ছিল।
এইজন্য এখনও আত্মপ্রসন্ন। দ্বিতীয়, ইংরেজি বই-এরও মূলে প্রায় একই মনোভাব, তবে শ্লেষ ছিল
অন্য ধরনের: ধূর্জটি পড়েই গেল, লিখল না কিছু। তৃতীয়, ইংরেজি বই-এর আদিতে ছিল একজন
বিশিষ্ট বন্ধুর বিশ্বাস যে বর্তমান ভারতীয় সভ্যতা সম্বন্ধে আমার কিছু বক্তব্য
আছে। তবু প্রেরণাটি নিতান্ত সৎ ছিল না,
কারণ লক্ষ করছিলাম যে আমার টুকরো প্ৰবন্ধ
ভাঙিয়ে একাধিক ব্যক্তি করে খাচ্ছে, এবং তাদের মুখ বন্ধ করবার জন্য লেখবার প্রয়োজন জেগেছিল।
শেষ বইখানি মুখ্যত অর্থকরী, গৌণত আত্মবিশ্বাসপ্রসূত।
বাংলা
প্ৰবন্ধ, গল্প, নভেলের মধ্যে শতকরা নব্বই ভাগ লিখেছি। পরের তাগিদে। টাকার
জন্য যা সব লিখেছি তার মধ্যে অধিকাংশই বাজে। বন্ধুদের অনুরোধই আমার কাছে বেশি
মূল্যবান। আমার নিজের বিশ্বাস এই যে, যখনই আমি চটে লিখেছি তখনই আমার লেখা সুখপাঠ্য হয়েছে!
প্রেরণায় আমি বিশ্বাস করি না। মাস দুই-তিন একটা বিষয় নিয়ে মেতে রইলাম, একটা কি দুটো
ছোট্ট ভাব মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করতে লাগল,
ছাত্র ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা কয়ে
সেগুলোকে স্পষ্ট করলাম, এমন সময় কোনো সম্পাদক জরুরি চিঠি পাঠালেন, লেখা চাই এখনই, একটা প্ৰবন্ধ
লিখলাম। গল্প ও নভেলের পিছনে রাগটাই প্ৰধান। অনুরাগের লেশ নেই।
মোটামুটি
দাঁড়ায় এই: লিখি দম্ভের জন্য, আত্মসম্মানের জন্য,
রাগ প্রকাশের জন্য প্রধানত। কখনও কখনও
নিতান্ত অল্পক্ষেত্রে লিখি নিজের মনোভাব সাজাতে, বাকিটা ব্রিজ না-খেলে সময়
কাটানোই উদ্দেশ্য। প্রকাশক ও সম্পাদক যদি আজ আমার বিপক্ষে ধর্মঘট করেন, তবে নিশ্চয়ই
নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে বই ছাপাব না। পরের উপকারের জন্যও লিখিনি, প্রেরণার
জন্যও নয়, এটাই সত্য উত্তর। আমি অন্তত জানি যে আমি তৃতীয় শ্রেণীর লেখক, প্রাণপণে
চেষ্টা করি দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠতে। সেইজন্যেই বোধহয়, ‘কেন’র চেয়ে ‘কেমন’-এর দিকে আমার
পক্ষপাত। বলা বাহুল্য এটা আমার বিনয় নয়,
কারণ চতুর্থ শ্রেণীর লেখক-সম্প্রদায় আজও
নিৰ্মূল হয়নি বাংলাদেশ থেকে।