আজ

ভালোবাসা— না লেখা চিঠি





এমরান হোসেন রাসেল©


তোমার কাছে চিঠি লিখিনি কোনদিন। আজ চিঠির যুগ না। যদি লিখতাম তবে কী লিখতাম ! তাই ভাবছি। লিখতে পারি নি, লেখার হাত ছিল না ।

জানি না তোমার পড়ার সুযোগ হবে কী না ! তবু নিজের একান্ত কথাগুলো অক্ষরে-অক্ষরে সাজাতে মন চাইছে, যেমনটি তুমি জীবন সাজাতে চেয়েছিলে।

বহুদিন বহুবার তোমার কলেজের পাশের ক্যান্টিনটিতে অপেক্ষা করেছি। নানারকম হালকা খাবারে সময় কাটাতাম, জাঁদরেল দোকানি যা কখনোই তোমাকে জানায় নি। ক্যান্টিনের দোকানী ছেলেটা বুঝতো আমি কার অপেক্ষায় আছি, তার মনে পেণ্ডুলামের মতো একটি প্রশ্ন দুলতো যা তার চোখের আরশিতে পষ্ট বোঝা যেতো। তার চাহনিতে থাকতো একটি প্রশ্ন 'আজ কী দেখা করবে'? হয়তো মনের সাথে বাজী ধরে কখনও কখনও জিতে গেলেও বেশিরভাগই হারতো, তার একমাত্র স্বাক্ষী আমার কিছু দূর্লভ ক্ষণ। তুমি চোখ নিচু করে দোকানের পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময়, আমার দিকে তাকানো দোকানীর বোবা প্রশ্ন, 'চলে তো যাচ্ছে' ? আমার ভাবমুর্তির কোন পরিবর্তন হতো না দেখে হয়তো দোকানী কষ্টই পেতো। তোমাকে কোনদিনই জানতে দেই নি সেই কথা। আমি আছি, তুমি জানতে না বলেই এদিকে তাকাতে না, জানলে দৌড়ে আসতে, সে আমার জানা ছিল। কথাগুলো লিখে জানাতে পারতাম, কিন্তু চিঠি তোমাকে লিখতে পারি নি।

যেদিন সকালে ডাক-পিয়ন অন্য-নামের তোমার চিঠি দিয়ে যেত, খুলে পড়ে মনটা ছটফট করতো। কত চেষ্টা করেছি উত্তর দি, সম্ভব হয় নি উত্তর লেখা। তোমার চিঠিতে বরাবরের মতো- আমি তোমাকে উপেক্ষা করি, আমি তোমাকে ভালোবাসি না, অন্য কাউকে নিয়ে যেন সুখী হই, তুমি দূরে চলে যাবে, তুমি সুন্দর নও তাই তোমাকে পছন্দ করি না, এসব বিষয় ভরে থাকতো তোমার আক্ষেপনামায়। হ্যাঁ, তোমার চিঠিগুলোর নাম আক্ষেপনামাই দিয়েছিলাম। তোমার অবুঝ মনে কত কিছু নিয়ে আক্ষেপ ছিল। এমন আক্ষেপনামা কেবিনেটের একটি দেরাজে আজও স্থান দখল করে রেখেছে, যেমন তুমি আমার হৃদয়ে, দু'জনের যুগল-সময়গুলো জীবনের হারানো সময়ে, তোমার ভাবনা স্মৃতি-তরঙ্গে স্থান করে রেখেছে। চিঠিটি পড়ে, পকেটে পুরে ছুটতাম বাস কাউন্টারের দিকে চিঠির উত্তর মুখোমুখি দেবো এই ভেবে; বেশির ভাগ সময়ই যা হয়ে উঠেনি ! তবু নেশাতুর দৃষ্টিতে তোমাকে দেখতেই যেতাম ! ১৮ কিলোমিটারের রাস্তাকে মনে হতো ১৮ আলোকবর্ষের রাস্তা ! যেন ফুরায় না ! চিঠিতে কীভাবে এগুলো লিখতে হয় জানা ছিল না।

একবার তুমি চিঠিতে লিখেছিলে তোমার এক বান্ধবীর কথা, নাম ফামিদা। তার দুঃখ তোমাকে ভাবায়, তোমাকে কাঁদায়। বহু অনুরোধের পর শীতের কোন একদিন তাদের বাসায় নিয়ে গেলে। সেদিন আমি তোমাকে আবিস্কার করলাম অন্যরূপে। ততদিনেও তোমার ভালোবাসা, হৃদ্যতা, মমতা যে আমার হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি তা বুঝলাম, সেগুলো যেন শীতের সকালের আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠলো আমার মনে। সেদিন গুণাম্বিতা তুমি আমাকে শুধু মুগ্ধই করো নি, সম্মান ও শ্রদ্ধা-ও অর্জন করে নিয়ে ছিলে। সম্ভবত তোমার সাথে দেখা করতে গিয়ে দেরীতে ফিরতে শুরু হলো সেদিন থেকেই। অন্যদিন তুমি বাড়ি তাড়াতাড়ি ফিরতে চাইলেও, সেদিন তুমি দেরী করলে। সাড়া বিকাল তোমার নতুন-রূপ আমাকে মোহমুগ্ধ করে রেখেছিল। ফেরার পথে সারাক্ষণ তোমাকে একটি সুন্দর চিঠি লিখবো ভেবেই কেটে গেল। লিখতে বসে বুঝলাম কী করে যে লিখবো ? জানি না !

সেবার তোমাদের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি, ছিলামও দু'তিন দিন। তোমার বড় ভাইয়ের বন্ধু শান্ত, অনেক মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে হাতে গুজে দিল একটি ভাঁজ করা কাগজ। নিখুঁতভাবে চিঠিটির হাত-পরিবর্তন হলো। সেদিনই জানলাম বয়সে বড় হয়েও সে তোমার একজন ভালো বন্ধু । কাগজটি হাতে দিয়ে দু'টি শব্দ বলেছিল, 'উত্তর দিয়েন', স্পষ্ট মনে আছে। জবাবহীন দৃষ্টি বিনিময় ছাড়া আমার কিছুই করার ছিল না। চিঠিটির ভাষায় ছিল শান্তির পরশ, স্নিগ্ধ ভালোবাসা, নির্মোহ পরিপাটি। তোমার অসহিষ্ণুতা আড়াল হয়েছিল ভাষার গভীরতায়। অধিকার আদায়ের আবদার তুমি রাখলে আমার কাছে, তোমার বাড়ির মানুষরা আন্দাজ করেছে তোমার পছন্দ, কারোর আপত্তি নেই। তোমার চিঠির উত্তর সপ্তাহজুড়ে লেখার চেষ্টা করেছি কিন্তু লিখতে পারি নি।

পাঁচদোনায় তোমার আন্টির অফিসে যাওয়ার কথা মনে আছে নিশ্চয়। সে অফিসের কাজে বাইরে ছিলেন, অপেক্ষার জন্য কোয়ার্টারে গেলাম আমরা। সেদিন তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে, বুকে মাথা রেখে বললে, 'তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবে না'। জীবন সাজানোর যত আয়োজন, যত ভাবনা সব তুমি একে একে বলে শান্ত হলে। আমাকে সুখ-স্বপ্নে বিভোর করে দিলে, তোমার স্বপ্নের আবেশে আমার শরীর-মন অবশ হলো। দুপুর গড়িয়ে কখন যে বিকেল হয়েছে বুঝতেও পারি নি। গ্রামীণ পরিবেশের সুপাড়ি গাছে ঘেরা অফিস, হালকা শীত শীত বসন্তের ঘোলাটে বিকেল আর সুন্দর সুন্দর ফুলগাছে গোছানো খোলা আঙিনায় দীর্ঘ আলাপে নানান বিষয়ে সময় কেটে গেলেও, সুখ-স্বপ্নের বিষে অবশ আমার মনে শুধু তুমি ছিলে, শুধুই তুমি। চক্ষু আর মনশ্চক্ষু দু-ই ছিল তোমার পানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পশ্চিম আকাশে সরু একফলা দেহ নিয়ে চাঁদ, তার সাথে শুকতারা সন্ধ্যার অস্তিত্ব জানান দিল। কিছুক্ষণ আগেই যে মন ভালোবাসার দ্রবণে দ্রবীভূত, সেই রেশ কাটতে না কাটতেই মনোরম এ পরিবেশ তা বাস্পীভূত করে দিল। মন কিছুতেই তোমাকে-ছাড়া হতে চাইছে না। সারাক্ষণ পাশে রাখার-থাকার এক অঙ্গীকার নিয়ে মন তুমুল ব্যস্ত। ফেরার অর্ধেক পথে, যখন তুমি নিজ ঠিকানার দিকে পা বাড়ালে, সেই বাষ্পীত মন যেন বিচ্ছেদের যন্ত্রনায় ছাই হয়ে গেল । তোমার প্রাণের ভিন্ন স্পর্শে অতৃপ্তি হলো আমার মন। ডিফারেন্ট টাচ্‌-এর গানটি যেন বাস্তবতা পেল।

স্বর্ণালী সন্ধ্যায় দূর অজানায়
হারাতে চায় এই মন
আকাশপানে ঐ দেখো চেয়ে
জানিনা কোন সে কারন ।

কখন যেন সে আমার হয়ে
মেঘের ফাঁকে চাঁদ উঠলো কণায়
হারাবে জানি কখন !! ....
প্রেমের জলে তার মন ভেজালো
হৃদয়ে দোলা দিয়ে সে এমন

এমন মানসিক আর পারিপার্শ্বিক চাপ আমার মন-মগজকে বাকী পথে ভাবনায় আচ্ছন্ন রাখলো। মনের সব কথা খাতার পাতায় অকৃপণ হৃদয়ে উজাড় করা ভালোবাসায় লিখে তোমাকে জানাবো, কিন্তু কাগজ আর কলম সারারাতের সঙ্গী হলেও, তোমাকে সঙ্গী করবো এমন কথা লিখতে পারলাম না সাদা কাগজে। সাদা কাগজ সাদা থেকেই ভোরের সূর্য দেখলো।

আজ স্মৃতিমন্থনে স্মৃতি'র কথা মনে পড়লো। বয়সে তোমার কিছু ছোট, যে তোমার ভালোবাসায় অন্ধ। বড়দের মাঝে তোমাদের দু'জনকে নিয়ে বেশ দুষ্ট-মিষ্ট কথা প্রচলিত ছিল । তাকে নিয়ে আমরা পদ্মাপাড়ে যেদিন ঘুরতে গেলাম, গ্রীষ্মের সেইদিনটি স্মৃতিতে একটি স্থান নিয়ে আছে। সাঁতার না জানা আমি স্পীড-বোটে ঘুরতে না চাইলেও তোমরা ঠিকই আমাকে রাজী করিয়ে নিলে। পনের মিনিট ঘুরবো। কিন্তু তোমার বাতাসে উড়ন্ত দীর্ঘ চুল, নির্মল মুক্তা ঝড়া হাসি, আমাকে খামচে ধরে জানতে চাওয়া "কোনদিন তোমাকে যেন না ছেড়ে চলে যাই" আর পানির বিন্দু বিন্দু ছিটে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল আমার হৃদয়, সেই ভেজা হৃদয় ভুলেই গিয়েছিল জীবনসংশয়ের কথা। স্পীড-বোটে আমার সজাগ-মনের মৃত্যু হয়েছিল। মরা-মনের সেই আমি রাতে খাতা-কলমের শরণাপন্ন হয়েও বিফল হই। মরা-মনের কথাগুলো কোনভাবেই খাতায় স্থান করে নিতে পারেনি।

আমার জানা ছিল না, কী করে আমার মনের কথাগুলো সাদা-কাগজে অক্ষরের তুলিতে এঁকে তোমাকে দেব। প্রকাশে অক্ষম আমার মনের রঙধনুর সাতরঙে তুমিই ছিলে। আজ চিঠিহীন যুগে লিখে পাঠালেও সেই তুমি বহুদূরে, অন্য কারো'র।