এমরান হোসেন রাসেল©
নেপাল ভ্রমণের স্মৃতি ভুলে যেতে চাই, মুছে
দিতে চাই হৃদয় থেকে কিন্তু যত মুছে ফেলতে চাই ততই মনের গহিনে আস্তানা নেয়।
সাল
২০০৪, ফেব্রুয়ারী কি মার্চ, কোন একদিন বাই-রোড চায়নার
উদ্দেশ্য যাত্রা করলাম। ভারত হয়ে নেপাল, নেপাল হয়ে চায়না।
সঙ্গীহীন আমার সাথে একটি Sports Bag তাতে কাপড়চোপড়, দু’একটি বই ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র আর একটি Waist
Bag-এ পাসপোর্ট, ডলার, কলম-কাগজ।
ভিসার কথাগুলো যথাস্থানে বলব। যাত্রার উদ্দেশ্য ব্যবসায়িক, ছুটি
কাঁটানোর বিনোদন-যাত্রা নয়।
ঢাকা
থেকে লালমনিরহাটের উদ্দেশ্যে ‘রোজিনা’ নামক
চেয়ারকোচে যাত্রা শুরু করলাম। পাশের সিটে এক বৃদ্ধ লোক, এত
বৃদ্ধ যে তাঁর সাথে কি বিষয়ে আলাপ করবো চিন্তা করতে করতেই ভদ্রলোক ঘুমের জগতে চলে
গেলেন, সাড়া পথে কোন সময় আমার কাঁধে মাথা দিয়ে, কোন সময় গ্লাসে মাথা রেখে নাক ডেকে যাত্রা শেষ করলেন। তখন দীর্ঘযাত্রায়
একটি অলিখিত নিয়ম ছিল, গাড়ী চলা শুরুর মূর্হুতে কোরান
তেলাওয়াত করা, সবাইকে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় শুনতে হতো আর
ক্লান্তিনাশক ছিল কিশোর কুমারের ‘মোর স্বপ্নে সাথী তুমি’
বা ‘পৃথিবী বদলে গেছে’- টাইপের
গান, কারোর অপছন্দ হলেও কিছু করার ছিল না, অনেকটা বাধ্য হয়েই শুনতে হতো। সেইদিনগুলোতে কোন এমপিথ্রি প্লেয়ার ছিল না
যে, কানে গুজে পছন্দসই গান যাত্রার আনন্দ দ্বিগুণ করতো।
যাক
সেকথা, ভালোয় ভালোয় সকাল ৫/৬টার দিকে লালমনিরহাটস্থ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত
বুড়িমারী স্থলবন্দর চেকপোস্টে এসে পৌঁছুলাম। লালমনিরহাট জেলাটি মনে হলো লম্বায় বেশ
দীর্ঘ, কারণ আমাদের বাসটি তিস্তার পাশ-ঘেঁষা একটি রাস্তা
দিয়ে অনেকক্ষণ চলেছে। আসার সময় কয়েকটি জায়গার নাম মনে দোলায় দেয়— হাতিবান্ধা, পাটগ্রাম, বুড়িমারী।
ছোটবেলায় ভাবতাম গাইবান্ধা নামকরণ হয়েছে গাই-গোরু বাঁধা ছিল বলে, এখন দেখছি বাংলাদেশে হাতিও বান্ধা থাকতো; পাটগ্রাম,
এখানে কী শুধু পাট চাষ হয়? ধান চাষ হয় না,
তবে এরা খেতো কী? বুড়িমারী এখানে কী বুড়িদের
মারে, অভিধান খুঁজেও সদুত্তর মেলেনি। ভারতের কিছু জায়গার নাম
পরবর্তীতে আরও অদ্ভুত লেগেছে— চেঙ্গরাবান্ধা (চেঙ্গরাদের
বেঁধে রাখা হতো কি?), ‘ফাঁসি দেওয়া’ (কাকে
ফাঁসি কে দিল?), ‘রাজাভাত খাওয়া’( কোন
রাজা ভাত খেল, রাজা তো প্রতিদিনই ভাত খায় বিশেষ কি ব্যাপার
হয়েছিল, যে জায়গার নাম ‘রাজাভাত খাওয়া’
হয়ে গেল) ইত্যাদি।
কাস্টমস, ইমিগ্রেশন
অফিস কোনটি তখনও খুলেনি, খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো।
অদূরেই ছন দিয়ে একটি বড় যাত্রী-ছাউনি’র মতো তাতেই আগত
যাত্রীর দল অপেক্ষা করছে, আমিও গেলাম, বিকল্প
কিছু ছিল না বলে। আমাদের বাস যাত্রী নামিয়ে কাউন্টারে চলে গেছে, আশেপাশে কয়েকটি ঝুঁপড়ি-দোকান, তাও বন্ধ। অপেক্ষারত
যাত্রীদের কথাবার্তায় মনে হলো, তারা দার্জিলিঙের বিভিন্ন
স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ও অভিবাবক। অফিস খুললে লাইন ধরে দু’দেশের
কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন শেষ করে ভারত ঢুকলাম। দু’প্রান্তেই
পঞ্চাশ/এক’শ করে ঘুষ দিতে হলো বিনা কারণে। অপেক্ষার ফাঁকে এক
সময় ঝুঁপড়ি দোকানগুলোর একটিতে নাস্তা সেরে নিলাম। সরকারী কার্যক্রম শেষ করতে করতে
প্রায় সাড়ে নয়টা বেঁজে গেল।
ইমিগ্রেশন
অফিসের অদূরেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, সেখান থেকে শিলিগুড়ি যেতে
ট্যাক্সিতে জনপ্রতি ১০০ রুপি, বেশি চিন্তা-ভাবনা না করে উঠে
পড়লাম। ৮৫/৯০ কিলোমিটার রাস্তার যাত্রা শেষ হলো তিন ঘন্টায়। শিলিগুড়িতে এর আগেও
একবার এসেছি, দু’জন বাঙালির সাথে ভালো
সখ্যতা হয়েছিল, আত্মীয়-আত্মীয় ভাব। একজন কাপড়ের দোকান মালিক,
ভদ্রলোকের নাম মনে নেই, তার ছেলের নাম রিন্টু ;
অন্যজন আবাসিক হোটেল মালিক, তাঁর হোটেলেই
ছিলাম। তিনি ইঞ্জিনিয়ার, ইন্ডিয়ান রেলে চাকুরী করতেন,
অসুস্থ হওয়াতে তাঁর একমাত্র মেয়ে এবং জামাই মিলে হোটেলটি চালায়,
তারাও খুব অমায়িক। রেন্টুদের দোকানে গেলাম, আমাকে
দেখে মনে হলো রেন্টু ভূত দেখলো।
আরে
দাদা, কখন আসলে? আর কে কে এসছে?
এই
মাত্র ! আমি একা। কেমন আছ?
হ্যাঁ, ভালো
আছি। একা ? তার একা বলার ধরণটি এমন ছিল, যে মনে হলো আমি বোধহয় তিন/চার বছরের শিশু, বাড়ি থেকে
কাউকে কিছু না বলে বেড়িয়ে পড়েছি।
বাসায়
সবাই ভালো আছেন? বাবা কৈ?
হ্যাঁ, সবাই
ভালো আছেন, বাবা একটু কাজে বাইরে গেছেন।
রিন্টু
আমি একটু ফ্রেস হয়ে আসি, নন-স্টপ জার্নিতে ক্লান্ত লাগছে।
আচ্ছা
আচ্ছা, কাকুর হোটেলেই তো উঠছ? নাকি? সেই
হোটেল মালিক রেন্টুর কাকু, তার বাবার বন্ধু।
না, আমি
হোটেলে উঠছি না, আমাকে এখনই আবার রওনা দিবে হবে।
দার্জিলিং
যাচ্ছ নিশ্চয়!
না, না,
এবার ঘুরতে আসিনি। দার্জিলিং নয়, আমাকে একটু
নেপাল যেতে হবে। তোমাদের এখানে ব্যাগটা একটু রাখা যাবে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ,
নিশ্চয়।
ব্যাগ
রেখে রিন্টুর কাকু’র হোটেলে গিয়ে ফ্রেস হয়ে, খাওয়া-দাওয়া
সেরে দোকানে ফিরলাম। ১০/১৫ মিনিট রিন্টুর সাথে খোশগল্প করে কাটিয়ে দিলাম, আসলে আমি অপেক্ষা করছিলাম ওর বাবার জন্য, পথ
সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা নেওয়া। আসছে না দেখে রিন্টু’র
কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাণীগঞ্জ-কাঁকড়ভিটা ভারত-নেপাল সীমান্তের
উদ্দেশ্যে।
এই
পর্যন্ত রাস্তা-ঘাট আমার মোটামুটি জানা-বোঝা ছিল; এখন যেদিকে পা বাড়ালাম,
তা একেবারে অজানা, অচেনা গন্তব্য। এ গন্তব্য
শুধু গন্তব্য নয়, ভয়ঙ্কর গন্তব্য আগে বুঝিনি। এখানে বলে রাখি,
রিন্টু’র বাবার সাথে দেখা হলে হয়তো আমার এই
ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা অর্জন হতো না; তিনি হয়তো আমাকে বারণ করতেন।
টাটা
সুমোতে পানিরট্যাঙ্কি জনপ্রতি ৩০ রুপি, প্রায় ২৭/২৮ কিলোমিটারের পথ।
ভাগ্যক্রমে সামনের সিটই পেলাম; হিলকার্ট রোড় থেকে গাড়ী
যাত্রা করলো, কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ি একটি ব্রীজ পাড় হলো।
আমার পাশের সিটে একটি উঠতি যুবক, দেখে মনে হয় কলেজ-ছাত্র;
সামনে তিনজন বসা অর্থাৎ ড্রাইভার, আমি আর সেই
যুবক। উদ্দেশ্যহীন প্রশ্ন, এ নদীর নাম কি ?
কলেজ-ছাত্রটির
ছোট উত্তর,
‘মহানন্দা। ’
‘আচ্ছা, তাই !’
কিছুটা
আশ্চর্যবোধ করায় ছেলেটি বলল, ‘এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে?’ তার অবাক চেহারা রেয়ার মিররে দেখতে পাই। ’
বললাম, ‘অভিমানী
নদীটি প্রকৃতির কান্নাকেই ধারণ করে বেঁচে থাকে, প্রতি বর্ষায়
যৌবন ফিরে পায়, অভিমান ভাঙ্গে।’
ছেলেটি, ‘এ
তো জানা কথা।’
‘নবযৌবনপ্রাপ্ত নদীর উন্মত্ততায় দু’পাশের অবস্থা করুণ, বিষণ্ণ, বিমর্ষ; আশেপাশের কোনকিছুই তাকে মর্মস্পর্শী, হৃদয়স্পর্শী করে না, তার কলকল ধ্বনি যেন শোকসঙ্গীতে রূপ নেয়।’
‘কই কখনো তো দেখিনি?’ আবার প্রশ্ন।
দার্জিলিঙের
কার্শিয়াঙে জন্ম নেওয়া এই নদীটি ঠাট্টাতেও পারঙ্গম।
‘কেমন করে?’ তার কৌতূহলী দৃষ্টি স্পষ্ট।
পাহাড়
থেকে এঁকে-বেঁকে এসে শিলিগুড়ির উপর হয়ে চলে গেছে আরও বহুদূর।
‘হ্যাঁ, মালদা পর্যন্ত’। ছেলেটি
হালকা ভাবে বলে। তার চটপট প্রত্যুত্তরে আমার কথা সম্পূর্ণ হচ্ছিল না।
বলছি
শুনুন তাহলে বলে তাকে কিছুটা থামাই, তারপর বলি, ‘নদীটা এক সময় বাংলাদেশের পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া ঢুকেছে; মাত্র তিন কিলোমিটার হেঁটেই ভারতে ফিরে এসে মালদার পথে বেশখানিকটা পথ
হাঁটে, বাংলাদেশের নবাবগঞ্জের ভোলাহাট দিয়ে আবার বাংলাদেশে
ঢুকে, সেখানেও ঐরকম কিছু দূর হাঁটার পর আবার ভারতের মালদা
জেলার বাকনার অদূরে আশরাফপুরে চলে আসে, কিছুটা পথ গিয়ে আবার
বাংলাদেশ চলে যায়। মহানন্দার এই দাম্ভিক পথ চলা যেন সীমান্ত নির্ধারনকারীদের প্রতি
অবজ্ঞা প্রদর্শন। আপন মনে চলে সে, মর্জিমাফিক আসে-যায়। এ
ঠাট্টা নয় তো কি?’
ছেলেটির
মোহাবিষ্ট প্রশ্ন, ‘আবার ভারত চলে আসে?’
‘না, মহানন্দা আর ফিরে না; মহানন্দার
মশকরা এখানেই শেষ। ৩৬ কিলোমিটারের মতো হেঁটে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে এসে সে যেন নিজেই
লজ্জা পায়; ঝাঁপ দেয় পদ্মায়, নিজেকে
লীন করতে।’ এই কথার পর ছেলেটি চুপ হয়ে পড়ে আর মহানন্দাও
আমাদের দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায়, আমরাও স্তব্দ হয়ে পড়ি।
সামনের
দালান-কোঠার মাথার উপর আকাশে মনে হচ্ছে মেঘের রাজ্য। কেমন ধূসর একটি লক্ষ্যের দিকে
গাড়ী এগিয়ে যাচ্ছে, এই ধূসরতা হলো মেঘ আর পাহাড়ের গায়ের সবুজ বনরাজি’র মিশ্রিত অবয়ব। সেই সবুজ মেঘের দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। একটা সময়
পাহাড়গুলোকে ডানে রেখে দার্জিলিং মোড় থেকে গাড়ি বামে মোড় নিল। হাতের ডানে পড়ে রইল
দার্জিলিঙের পথ। মনটা খারাপ হয়ে গেল; দার্জিলিঙের এতো কাছ
দিয়ে চলে যাচ্ছি, অথচ দার্জিলিং যাওয়া হলো না। প্রথমবার
দার্জিলিঙে গিয়ে একটি ঘটনা ঘটেছিল। হোটেল রুমে ঢুকে দার্জিলিঙের নিস্তব্ধতা আমার
জীবনের ঘড়ি বন্ধ করে দিয়েছিল, তার মুগ্ধতায় আমি কয়েক মিনিটের
জন্য পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। জানালা দিয়ে তাকিয়েই ছিলাম। সেই দৃশ্য আমাকে প্রায় ৫
মিনিট stiff করে দিয়েছিল; কোন কথা না,
প্রশ্নের কোন জবাব না; সাথের বন্ধুরা ভয় পেয়ে
যায় তাতে, একথা পরে তাদের মুখে শুনেছি। চলতি রাস্তায়
দার্জিলিঙের নিস্তব্ধতা বুঝতে পারিনি। আমার দেখা সবচেয়ে নিস্তব্ধ-স্থান হলো
দার্জিলিং।
পাহাড়
খুব পছন্দ। পরিচিত মানুষদের বেশির ভাগকে বলতে শুনেছি তাদের সমুদ্র ভালো লাগে, আমার
সমুদ্র মোটেই ভালো লাগে না, পাহাড় ভালো লাগে। কি সুন্দর !
নিশ্চুপ ! নিস্তব্ধ ! পাহাড়ের কাজ শুধু দেখা; সবকিছু শুধু
দেখে যায়, নির্বিবাদে, নির্ঝঞ্ঝাটে
মানুষের শত অত্যাচার সহ্য করে যায় । কতকিছুর সাক্ষী সে! তার পেটের কত সুখ-দুঃখের,
আনন্দ-বেদনার, উত্থান-পতনের নির্জলা গল্প। এই
মূকের ভাষা থাকলে কত শত অসত্য সত্য হয়ে যেত, সত্য অসত্য হত;
শত শত সত্য-অসত্যের প্রমাণ নিজ বুকে ধারণ করে আছে সে ! কত কাল ধরে
নিজের গায়ে প্রতিপালিত করছে কত নীঝর-ধারা, যার প্রতি বাঁকে
কত গল্প, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না,পাওয়া-না-পাওয়া কথা। প্রকৃতি মানুষকে দেয় নির্বিচারে, হৃষ্টচিত্তে, উদার হাতে, দরাজ
গলায়; আমাদের হৃদয়ের বিচার কখনোই প্রকৃতির সাথে তুলনা চলে
না।
সোজা
পথে গাড়ি চলল কিছুক্ষণ, আমাদের গাড়ি আরেকটি ব্রিজ পাড় হলো, পাশে ছেলেটি বলে উঠল, ‘এটি বালাসন নদী, এ-ও মহানন্দার সাথে যুক্ত। এর বালি আর পাথর ঘর-বাড়ি তৈরীর কাজের জন্য
বিখ্যাত খুব।’
‘বাহ, বেশ তো মহানন্দার আরেকটি সম্পর্ক জানা গেল’
ড্রাইভারের
‘ভার্সিটি, ভার্সিটি’, বলাতে
আমাদের কথায় ছেদ পড়ে; সাড়াক্ষণের পথ চলায় সে যেন এক মৌনব্রত
তপস্বী।
ইউনিভার্সিটির
রাস্তায় ছেলেটি নেমে পড়ল, ‘ভালো লাগলো কথা বলে; মহানন্দার
পূর্ণ জীবনী আজ জানা গেল।’ আমি কিছু বলার আগেই গাড়ি আগে বেড়ে
গেল; পাশে কোন যাত্রী না উঠায় একটু আরাম করে বসতে পারলাম।
বিদ্যার্থীদের জনসমুদ্রে সে মিলিয়ে গেল, কিছুপথ এদের
নবযৌবনের কলোচ্ছ্বাস, কলোরব মনটাকে প্রকৃতি থেকে দূরে সরিয়ে
রাখলো।
মহানন্দার
গল্পে বিভর থাকাকালীন নয়নাভিরাম প্রকৃতির আরেকরূপ চোখে পড়ল— চা
বাগান। জীবনে প্রথম সমতল ভূমিতে চা বাগান দেখলাম । সিলেটের চা বাগান যে কয়টা দেখা
হয়েছে তা— হয় পাহাড়ে, নয় টিলায়;
আমার এই ভ্রমণের পর অবশ্য পঞ্চগড়ের এমন সমতল ভূমির চা বাগান
বাংলাদেশে হয়েছে।
একটি
জায়গায় আস্তে আস্তে আশে-পাশে জনবসতি বাড়তে লাগলো; দোকানপাট, হোটেল-মোটেল, ব্যাংঙ্ক, স্টুডিও
সবই একটু একটু করে দেখা যাচ্ছে, মানুষের চলাচলও বাড়তে দেখা
গেল, একটি বাজারের মতো যায়গা এসে ড্রাইভার পেছনের যাত্রীদের
উদ্দেশ্যে বলল, ‘বাগডোগরা’। এটা
বাগডোগরা, শিলিগুড়ির একমাত্র এয়ারপোর্ট। একজন যাত্রী উঠল
আমার পাশে; পুরুষ্টু দাড়ি-মোচ, স্বাস্থ্যবান
সুপুরুষ, পড়নে লাল সালু দিয়ে লুঙ্গির মতো আর একই কাপড়ে
ফোতুয়া। তার বিশাল দেহটি আমাকে ড্রাইভারের দিকে চেঁপে বসতে বাধ্য করল। লোকটি উঠার
পর থেকেই বসতে পারছি না, ঠিকমতো। আবার লোকটি বারবার আড়চোখে
আমাকে দেখছে, মনে হলো কিছু বলতে চান। আমি সাহস করে বললাম। ‘কিছু বলবেন?’
‘না, তেমন কিছু না। বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, না?’
‘জী, বাংলাদেশ।’ আমি বুঝি না
কলকাতায় যতবার গিয়েছি, এর আগে দার্জিলিং যখন গিয়েছি সবাই যেন
নিশ্চিত হয়েই জিজ্ঞাসা করে আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন? এমন
কী দেখে তাঁরা বুঝে ফেলেন যে আমি বাংলাদেশের মানুষ। বিষয়টি আমাকে বহুদিন ভাবিয়েছে,
এখনও ভাবায়। কোন উত্তর এখনও পাইনি।
অল্প
কিছুক্ষণ পর লোকটি আচমকাই বলল, ‘চরকি’, ‘চরকি’।
মাথায়
একটি এয়ার্কি’র এলো, কিন্তু বয়সের ব্যবধান,
অচেনা-অজানা পথ আর বেশ-ভূষার কথা ভেবে দমে গেলাম।
তবু
বললাম,
‘চরকি, কি হয়েছে চরকি’র?’
না, জীবনটাই
একটি চরকি! আজ এখানে কাল ওখানে ! মা দূর্গা! দূর্গা মা !
স্ট্যায়ারিং
হুইল হাতে আমাদের মৌনব্রত তপস্বীও রাস্তা দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তারদিকে দু’একবার
দেখতে বাধ্য হলো; বুঝলাম এ আরও কঠিন তপস্বী। লোকটির চোখ
বন্ধ কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে, আপন মনে যা বলেছিল তারমধ্যে যা
এখনও মনে আছে, তাহলো—
তার
ঘর-সংসার নেই, আধ্যাত্মিকতাই তার জীবন, জগতের
মঙ্গলামঙ্গল সবকিছুই আগে নির্ধারিত আর সে সদ্য তিস্তার উৎস স্থল সিকিমের চিতামু
হ্রদ থেকে নিচে নেমে এসেছেন। জায়গা এত উপরে যে, সেখানে সবার
পক্ষে যাও সম্ভব নয়; শুধুমাত্র দৈহিকভাবে বলশালী হলেই কারোর
পক্ষে সেখানে পৌঁছান সম্ভব না, থাকতে হবে দেবী অপার কৃপা।
দেবী’র কৃপা কারোর ভাগ্যে জুটলেও, দেবী’র দর্শন জোটে কোটিতে দু’একজনের। তিনি পরম সৌভাগ্যবান
বলে দেবী পার্বতী’র সাথে তার সাক্ষাত হয়েছে; তার একটি বিবরণও দিয়েছিলেন যা আজ মনে নেই। দেবী’র
একটি বার্তাও তার কাছে আছে, যা আমার মনে গভীর আঁচর কাঁটে।
বার্তাটি এমন— “তিস্তার জন্ম দেবী’র
স্তন থেকে, মানুষ্য সমাজে এই পানিরূপী দুধের পবিত্রতা যেন
রক্ষা করা হয়, নয়তো তাঁর অফুরান ভাণ্ডার থেকে সবাই বঞ্চিত
হবে।” এতটুকুই মনে আছে, তাই বলতে
পারলাম।
পরে জেনেছি, আসলেই তিস্তার উৎপত্তি সিকিমে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭২০০ মিটার উঁচুতে চিতামু হ্রদ-এ। এবং তিস্তা নামটি ‘তিন প্রবাহ’ থেকে উৎপত্তি। বাংলাদেশে তিস্তা একসময় করতোয়া নদীর মাধ্যমে গঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল এবং এর অংশবিশেষ এখনও বুড়ি তিস্তা নামে পরিচিত। বাংলাদেশ নদীর দেশ; এখানে নদীর ছড়াছড়ি, আমাদের পার্শ্ববর্তীদেশ দু’টি থেকে আগত ৫৮টি নদীর মধ্যে ৫৫টি ভারত থেকে আর মাত্র ৩টি মায়ানমার থেকে। সম্প্রতি তিস্তার পানি-বন্টন নিয়ে দু’দেশে সরকারী পর্যায়ে বহু জল-ঘোলা হয়েছে।
পরে
জেনেছি,
আসলেই তিস্তার উৎপত্তি সিকিমে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭২০০ মিটার উঁচুতে
চিতামু হ্রদ-এ। এবং তিস্তা নামটি ‘তিন প্রবাহ’ থেকে উৎপত্তি। বাংলাদেশে তিস্তা একসময় করতোয়া নদীর মাধ্যমে গঙ্গার সঙ্গে
সংযুক্ত ছিল এবং এর অংশবিশেষ এখনও বুড়ি তিস্তা নামে পরিচিত। বাংলাদেশ নদীর দেশ;
এখানে নদীর ছড়াছড়ি, আমাদের পার্শ্ববর্তীদেশ দু’টি থেকে আগত ৫৮টি নদীর মধ্যে ৫৫টি ভারত থেকে আর মাত্র ৩টি মায়ানমার থেকে।
সম্প্রতি তিস্তার পানি-বন্টন নিয়ে দু’দেশে সরকারী পর্যায়ে
বহু জল-ঘোলা হয়েছে।
আমরা
নিজের জন্য ৮০ শতাংশ পানি নিয়ে কাড়াকাড়ি করলেও খোদ তিস্তার জন্য রাখছি মাত্র ২০
শতাংশ। প্রকৃতি-বিধ্বংসী মানুষ তিস্তার জন্য রেখেছিল ১৯৮৩ সালে ২৫ শতাংশ। ঋষি
ব্যক্তির আধ্যাত্মিক-কথাগুলো গ্রহন করার পক্ষে কোন যৌক্তিক কারণ নেই ; তবু,
যেহেতু আমাদের উপমহাদেশে বিশ্বাসী’র কমতি নেই;
তাই তার বিশ্বাসের কথা ধরেই যদি কথাটি এভাবে বিবেচনা করি তবে কী
অন্যায় হবে— দেবীর স্তন থেকে যে নদীর জন্ম সেখানে আমরা একে
অপরকে কেন বঞ্চিত করছি?
যাক
সেসব কথা,
লোকটি নক্সালবাড়ির পথে নেমে গেল আর আমরাও পানিরট্যাঙ্কি কাছাকাছি
চলে এসেছি। সূর্যও ধীর পায়ে পশ্চিম দিকে চলছে, এতক্ষণ
উপভোগ্য রোদের কারনে শীত লাগেনি। এখন দু’পাশে বড় বড় গাছের
ছায়ায় শীত শীত লাগে, তাই গাড়ি যখন গাছের ছায়ার বাইরে আসে
শীতভাব কমে যায়, রোদের উষ্ণতা আরাম দেয়। নকশালবাড়ি নামটি
শুনেই মনটি যেন কেমন করে উঠল। মৌনব্রত তাপস্বী’কে বাধ্য
করলাম এবার ব্রত ভাঙ্গাতে। দু’তিনবার জিজ্ঞাসা করলাম আমরা
এখন নকশালবাড়ি? তার ছোট উত্তর, ‘সামনে’। নকশালবাড়ি— এতো চারু মজুমদার, কানু স্যানাল, অসীম চট্টোপাধ্যায় ও সন্তোষ রাণা
প্রমুখের। পরবর্তীতে শেষোক্ত দু’জনের অসন্তোষ এবং পদত্যাগ।
মাত্র ৯৬ পাউন্ড ওজনের, হাঁপানী আক্রান্ত এই মানুষটি (চারু
মজুমদার) তাঁর কর্মকান্ডে এই স্থানটি স্মরণীয় করেছেন। চারিদিক কেমন একটু লাগছে এখন,
পথের এইটুকু রাস্তা যেন একটি বিশেষ অনুভূতি দিচ্ছে শরীর ও মনে।
অবশ্য পুরো পথের তুলনায় নক্সালবাড়ি’র পরের পথটুকুতে মানুষের
সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু কেমন যেন শান্ত, নিরিবিলি মনোরম পরিবেশ।
হয়তো বা না ! হয়তো বা জায়গার নামটি শুনে আমার এমন লাগছে। কার্যকরণ জানি না কিন্তু
অনুভবটুকু বুঝতে পারছি। জায়গাটি পরিভ্রমণ করে মনে আরাম লাগছে, এটাই সত্য।
যাই
হোক পৌঁছে গেলাম পানির ট্যাংকি। ততক্ষণে সাড়ে তিনটার মতো বেঁজে গেছে। ভাবছি, সময়
বেশি হয়ে গেল কিনা ! বর্ডার ক্রস করতে কোন সমস্যা হয় নাকি ! নানান রকম দূর্ভাবনা?
এসব দুশ্চিন্তা মনে-মগজে কিলবিল করছে। আবার একটু একটু ক্ষিদাও
লেগেছে; একটি চায়ের দোকানে ডুকে ব্রিটানিয়া বিস্কুট, চা খেলাম আর ফাঁকে দোকানির কাছ থেকে নিশ্চিত হলাম আমার যে দেরি হয়নি। আরও
অনেকক্ষণ পর্যন্ত সময় হাতে আছে।
তবু, আর
দেরি না করে নেপাল-ভারতের রাণীগঞ্জ বর্ডারের দিকে পা বাড়ালাম।
রাণীগঞ্জ
চেকপোস্টটা চেঙ্গরাবান্ধা চেকপোস্ট থেকে একটু ভিন্ন। আগেরটি ছিল ইট-সিমেন্টের
দালান, এটি বাঁশ-কাঠের তৈরী। চেকপোস্টটি দেখতে কেমন যেন সহজ-সরল মনে হয়; বাঁশ-কাঠের
ঘরটির বাইরে বড় একটি টেবিল পাতা; সেখানেই সব কাজ হলো। যতদূর মনে পড়ে, কবে ভারত
এসেছি আর নেপাল কোথায় যাব এমন কয়েকটি সাধারণ প্রশ্ন করেই কাস্টমস্-ইমিগ্রেশনের
কাজ শেষ হয়েছিল, মনে আছে ব্যাগটি বেশ সময় নিয়ে ভালো মতো চেক হয়েছিল। আমি
খেয়াল করলাম, আমার পেছন দিয়ে নারী-পুরুষ-শিশু কাস্টম্স-ইমিগ্রেশন না করেই নেপালের
দিকে চলে যাচ্ছেন; দু’একজন সাইকেল চালিয়েও চলে গেলেন। সাধারণত এই রকম স্থানে
হরেকরকম যানবাহন লক্ষ করা যায়, কিন্তু অদূরে কিছু রিক্সা ছাড়া অন্যকোন যানবাহন দেখা
যাচ্ছে না। হেঁটেই সামনে এগিয়ে চললাম,
রাত থেকে বসে বসে হাত-পায়ে জং ধরা
অবস্থা। রিক্সাগুলোকে পাশ কেঁটে যাওয়ার সময় রিক্সাচালকরা কি বলে যে হাঁক ছাড়ল তার
মর্মার্থ আমার বোঝার বাইরে, একমাত্র ‘কাঁকড়ভিটা’ ছাড়া।
অল্প
কিছুদূর যেতেই নদীর উপর একটি সেতু পেলাম;
এটি পুরোনো হলেও দেখতে সুন্দর, অবস্থাও ভালো।
সেতুটিতে আগের দিনের জমিদার বাড়ির ছাদে যেমন হাঁটু অবধি রেলিং থাকতো, দু’পাশে তেমন
রেলিং দেওয়া। নিচের নদীতে পানি নেই, আছে গরু-মহিষ;
অদূরেই কিছু মানুষ সবুজ অংশে চাষকাজে
ব্যস্ত, বাকী নদী বালি আর পাথরে পূর্ণ । সূর্য পশ্চিমে ১৩৫ ডিগ্রী হেলে আছে, রোদের রং
পূর্ণ সোনালী, মুক্ত নীল আকাশ, খোলা প্রান্তরে মৃদু-মন্দ হাওয়া ক্রমে নেশা বাড়িয়ে দিচ্ছে, পাশ দিয়ে
রিক্সাচালকদের পেডেলের হালকা চাপ সময়কে করছে ধীর, হাতে ব্যাগ বা কাঁখে সন্তান নিয়ে
অনুত্তেজিত মানুষগুলোর প্রশান্ত হেঁটে চলা—
এমন সুস্থির পরিবেশ আমার পদচলা আর মনের
গতিকে মন্থর করে দিচ্ছে; পারিপার্শ্বিক মাদকতায় শরীর-মন অবশ হয়ে যাচ্ছে। এ যেন কয়েক
শ’বছর পূর্বের কোন জনপদ। আধুনিক যুগেও এদের কোন মোটর গাড়ি নেই, নিদেনপক্ষে
মোটর সাইকেল তো থাকার কথা,তাও নেই। পরে জানতে পারি, নদীটির নাম মেচী; এই নদীর নামেই
নেপালের এই অঞ্চলের নাম মেচী অঞ্চল। এটি মহানন্দারই পুত্র-কন্যা বা নাতি-নাতনী হবে
অর্থাৎ এটি মহানন্দার একটি উপনদী। এই স্রোতধারা ভারতে ঢুকে বিহারের গিয়ে আবার
মহানন্দার অপরাংশ যেটা বিহারের দিকে গেছে তার সাথে মিশেছে।
অবশ
শরীর-মন নিয়ে সেতুর গোড়ায় এসে দেখি একটি বিশাল ইট-সিমেন্টের পাকা তোরণ; দু’পাশে বড় বড় দু’টি থামের মতো
উঁচু দেওয়াল। তার উপরে একটি করে প্যাগোডার উপরি ভাগের সাদৃশ চৌকো আকার স্থাপত্য; মাঝেখান দিয়ে
রাস্তা, তার উপরিভাগে একটি আড়া; তাতে বড় স্থাপত্যের অনুরূপ আকারে ছোট তিন ধাপে তিনটি
স্থাপত্য। আগে কখনও চিনদেশে যায়নি, মনে হলো যেন চিনদেশে চলে এসেছি। এত তাড়াতাড়ি চিনের স্বাদ
গ্রহন করতে পারবো ভাবতে পারিনি, অবশ মনে একটু রোমাঞ্চও যোগ হলো। যাক সেকথা যতটুকু স্মরণ
আছে, দু’পাশের দেওয়ালে পাঁচটি করে সিমেন্ট-বালু দিয়ে নকশা আঁকা ছিল, দু’টির কথা এখনও
মনে আছে একপাশে নেপালের পতাকা আঁকা আর অন্য পাশে ছিল গরুর চিত্র। দু’টিই পরিচিত
বলে হয়তো এখনও মগজের স্থায়ী পরিষদে সদস্য হয়ে আছে, অন্যগুলো স্মৃতির অতল গহ্বরে
হারিয়ে গেছে।
সেতুর
শেষে রাস্তাটি অল্প একটু নেমে গেছে, দু’পাশ টিলার মতো। হাতের বামে একটি বোর্ডে কাঁকড়ভিটা(Kakarvitta) লেখা জায়গার নামটি বলে দেয় । ১০০/১৫০ মিটার দূরত্বের কিঞ্চিত
উৎরাই-চড়াই রাস্তা শেষে হাতের ডানে ইমিগ্রেশন অফিস দেখা গেল। দেখতে আমাদের দেশের
প্রাইমারি স্কুলের মতো; দোতলা বিল্ডিং,
বাউন্ডারি দেওয়া, ঢুকতে ছোট
একটি গেট। রাস্তার অন্যান্য পথচারিরা আমায় একা ফেলে এগিয়ে গেল; চলতি পথে আমার
দিকে অনেকের নির্বাক কৌতূহলী দৃষ্টি, ব্যাপারটি ভালো লাগল না। এই পর্যন্ত সবকিছু মর্জিমাফিক
হওয়াতে মনে কোন শঙ্কা জাগেনি, এই প্রথম একটু শঙ্কিত হলাম কিন্তু কী বিষয়ে শঙ্কিত হলাম, নিজেও জানি
না। অজানা যেকোন বিষয়েই মানুষের শঙ্কা থাকে,
এমন কী কখনও কখনও জানা বিষয়েও মানুষের
শঙ্কা জাগে। রাতের বেলায় নিজ বাড়ির পুকুরের মধ্যখানে যেতে হয়তো ভয় হয় না, কিন্তু শঙ্কা
হয়। এটা যে কিসের শঙ্কা মানুষ নিজেও জানে না। ঠিক তেমনই এক শঙ্কায় আমার মনে উদয়
হলো; হয়তো মানুষগুলোর দৃষ্টিপাতই এর কারণ হতে পারে, জানি না। অবশ
মন আর শঙ্কার বানকে ঝেরে সাহস সঞ্চার করে হলুদ-ঘরে প্রবেশ করলাম। ইমিগ্রেশন অফিসার
আসতে একটু দেরি আর ব্যাগ তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করা ছাড়া কোন সমস্যাই হলো না, এমনকি এরা কোন
টাকাও চাইলো না। ঢোকার আগে যে শঙ্কায় আমি কাহিল ছিলাম, তা যেন ফুরুত
করে উড়ে গেল।
পরবর্তী
অজানা পথ হেঁটেই চললাম। সূর্য পশ্চিমে তার কর্মক্লান্ত বদন নিয়ে বিদায়ে ব্যস্ত, ইটের তৈরী
দালানগুলো একতলা-দোতলা, বেশ ছাড়া ছাড়া। দালানগুলোর মাঝের ফাঁকা দিয়ে দিগন্ত দেখা
যায়। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে দেখে নিকট বাজারের উদ্দেশ্যে রিকশায় উঠলাম । রাস্তার
ডানপাশে ক্রমশ জনবসতি বাড়তে লাগলো, হোটেলও দেখা যাচ্ছে দু’একটি কিন্তু বাইরে থেকে হোটেলের
সুরত পছন্দ হচ্ছে না। দেখে মনে হয় এসব হোটেলে রাত কাটালে অক্সিজেনের অভাবে মরে
যাবো, হোটেলের গায়ে দূর্ভিক্ষের ছাপ;
ঘুপচিমার্কা হোটেলগুলো তার বিবর্ণতার, রুগ্নতার আর
অসুস্থতার কথা নিজেই বয়ান দিয়ে দিচ্ছে পথচারিদের। দিনের আলো কমে এসেছে অথচ এখনও
কোন আলো জ্বলেনি, মনে হচ্ছে হোটেলগুলো অন্ধও। যাক আরও এগিয়ে ডানে মোড় নিয়ে
রিক্সা এগিয়ে চলল। রাস্তাটির শেষে একটি হোটেল, বাইরে থেকেই পছন্দ হলো। এই
হোটেলটি আগেরগুলোর মতো নয়। কাউন্টারে একজন ছেলেবয়সী লোকের কাছে রুম চাইতেই রুম
পাওয়া গেল। রুম দোতলায়, ভাড়া প্রতিদিন আড়াই/তিন’শ ভারতীয় রুপি, পাঁচদিনের
জন্য নিলে ছাড় আছে, ছাড়ের অঙ্ক বেশ ভালো;
কিন্তু আমার পাঁচদিন থাকার কোন পরিকল্পনা
নাই, তাই ছাড়ে গেলাম না। বেশির চেয়ে বেশি একদিন থাকবো ! হোটেলটির নাম সম্ভবত
‘দরবার’, নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।
রুম
নেওয়ার যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার পর জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের রেষ্টুরেন্ট আছে? ইংরেজিতে
প্রশ্ন করলেও ছেলেটি হিন্দিতে উত্তর দিচ্ছে,
নিজের হিন্দি পরখ করার জন্য পরবর্তীতে
ভুলভাল হিন্দিই তার সাথে চালিয়ে গেছি।
হা সাব, হ্যাঁয়।
খানেকে
লিয়ে ক্যায়া মিলেগা?
সাব, ভাত মিলে গা, উসকে সাত
সাবজি হ্যাঁয়, মিট হ্যাঁয়, ডাল হ্যাঁয়, মাছলী নাহি হ্যাঁয়। আপকো আগে সে ওয়াডার কারনা হোগা, উসকে বাদ
মিলেগা। কথাগুলো এমনভাবে বলে শেষ করলো যে,
মনে হয় মাত্র কোন তোত্লা রোবটের সুইচ অফ
হলো। আমি ভাতের সাথে মাংস আর ডাল বললাম।
ঠিক
হ্যাঁয়।
ছেলেটি
দোতলায় রুম দেখাতে নিয়ে আসলো।
লোকাল
হোটেলগুলোতে উঠার আগে রুম দেখে নেওয়াই নিয়ম;
এখানে দেখিনি, কারণ ছেলেটি
রুম নেওয়ার সময় বলেছিল আপনি আপনার পছন্দ মতো যেকোন রুম নিতে পারবেন, বেশির ভাগ রুম
খালি আছে, ভাড়া কমন। ভাবলাম, নেপালের হোটেল ব্যবসা বেশ তো— এখানে
পর্যটকদের জন্য এত সুন্দর ব্যবস্থা যেকোন দেশের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে; একেই না বলে
জাত পর্যটক-ব্যবসায়ী।
ডবল
বেডের রুম, বাথরুমটি পরিস্কার ও সুন্দর;
পানিকে গরম-ঠাণ্ডা (Geyser) করার
ব্যবস্থাও রয়েছে, এসি আছে কিন্তু এই সময় এসির দরকার নেই, ছেলেটি রুম
দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল। রুমটিতে একটি বারান্দাও আছে, সেখান থেকে রাস্তা দেখা যায়; একটু পরেই
ছেলেটি মিনি-সাবান, মিনি-প্যাক শ্যাম্পু আর টাওয়াল নিয়ে দরজায় নক করলো।
আপকা
সাবুন,শ্যামপু !
ঠিক, হ্যাঁয়।
জালদিসে খানা লাগাও, বহুত ভুক লাগি হ্যায়,
বলে টাওয়াল ফিরিয়ে দিয়ে সাবান, শ্যাম্পু নিয়ে
সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে বাথরুমে চলে গেলাম।
দোতলার
দু’পাশে হোটেলের রুমগুলো, মাঝখানে খোলা একটি জায়গা; সেখানেই ডাইনিং-স্পেস।
ডাইনিং-স্পেসে একটি কমন টিভি আছে, একদিকে মিনিবারের মতো; সেখানে বিভিন্ন নামের রাম, হুইস্কি আর
বিয়ারের মতো মাথা গরম (না ঠাণ্ডা) করা পাণীয় বোতল সাজানো। আরেক পাশে একটি টেবিল
দিয়ে কাউন্টারের মতো, তার পেছনে একটি শো-কেসে বিভিন্ন বিস্কুট, সিগারেটের
প্যাকেট, বাদামের প্যাকেট, বডি স্প্রেসহ নানান রকম জিনিসে ভরা, যা বোর্ডারের
প্রয়োজনীতা মিটায়। খাওয়ার সময় একজন সাদা চামড়ার লোককে নিচ থেকে উপরে উঠতে দেখা
গেল। খাওয়া শেষে চা খাচ্ছি আর টিভিতে হিন্দি গান দেখছি, পাশেই ইংরেজ
লোকটি বসল। নিজেই পরিচয় দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
Hello, I’m David (সম্ভবত তাঁর নাম ডেভিড বলেছিল), I’m the Owner of this Hotel. আমার পরিচয় দিয়ে কুশল বিনিময় করলাম।
আমি চা
শেষে সিগারেট খাওয়ার জন্য সেখান থেকে আমার ঘরের বারান্দায় চলে এলাম। সিগারেট
খাচ্ছি আর ভাবছি, এখানেও বেনিয়া ইউরোপ এসে জুটেছে, এদের হাত থেকে
কোথাও রক্ষা নেই। সন্ধ্যার ঘন আবছায় হোটেলের ডান দিকের অল্পদূরে কিছু বাস দেখা
যাচ্ছে, বিকেলে আসার সময় বাসগুলোকে দেখেনি; সেখানে অনেক লোকজনও দেখা যাচ্ছে।
আকাশে মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে সিগারেট শেষ করে ঘরে ঢুকলাম।
খাওয়ার পর শরীর ছেড়ে দিলেও, নতুন জায়গার স্বাদ নিতে দেরি মন মানছে না। কিছুক্ষণ
বিশ্রাম নিয়ে, বাইরে বের হওয়ার জন্য সিড়ির দিকে যেতেই ইংরেজ ভদ্রলোক আমাকে ডেকে
মধুমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, রাতের বেলা, কাছাকাছিই যেন থাকি বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই।
আমি
বের হয়ে বাসগুলো যেখানে সেইদিকে হাঁটতে শুরু করলাম, কাছে গিয়ে দেখি জায়গাটায় মানুষে
দিয়ে ঠাসা। তারা যে ভাষায় কথা বলছে বুঝতে পারছি না, তবে তার মধ্য থেকে দু’একটি বাংলা
শব্দ ক্যামেরার ফ্লাশলাইটের মতো ঝলকানি দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে
তাদের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করলাম, পরলাম না। আমার একটি অভ্যাসের কথা অন্য একটি লেখায়
বলেছিলাম, আমি নতুন জায়গায় গেলে একটি জরিপ করে থাকি; বইয়ের দোকান, ওষুধের দোকান
আর চা-পান-বিড়ির দোকান গণনা। এখানেও করলাম;
বইয়ের দোকান একটিও দেখেনি, মুদি
দোকানগুলোতেই খাতা-পেন্সিল-কলম পাওয়া যায়,
ওষুধের দোকান তিন/চারটির মতো আর
পান-বিড়ির দোকান অনেক; এদের পান-বিড়ির দোকানে আরও একটি জিনিস বাড়তি পাওয়া যায়, ‘মদ’। ছোট ছোট
কাঁচের দরজাওয়ালা ফ্রিজে সুন্দর সুন্দর মদের বোতল দোকানগুলোর বাড়তি আকর্ষন। আরও
একটি বিষয় লক্ষনীয় বেশিরভাগ দোকানে মহিলারা বিক্রি-কিনি করছে; অনেককে
বাচ্চাসহ দোকান পরিচালনা করতে দেখেছি।
কিছুদূর
হাঁটাহাঁটি করে হোটেল ফিরলাম। উঠতেই ডেভিডকে সেখানেই বসা দেখলাম, সাথে সেই
ছেলেটি আর ছোট একটি বাচ্চাসহ একজন তরুণী। আমাকে দেখে সোফা দেখিয়ে বলল, Please Sit Down. বসলাম। তিনি টিভির Volume কমিয়ে দিয়ে আমার দিক মুখ করে বসলেন।
এখানে
কতদিন থাকছেন ?
আজ
রাতটুকুই থাকবো।
আচ্ছা।
আপনি এখান থেকে কোথায় যাবেন?
কাঠমাণ্ডু।
ঘুরতে
না ব্যবসার জন্য ?
ব্যবসায়িক
কাজ। শুনেছি নেপালে বাংলাদেশি জিনিস-পত্রের অনেক চাহিদা, বিশেষ করে
গার্মেন্টসের প্যান্ট-গেঞ্জি, তাছাড়া সাবান,
তেল, কসমেটিকস্, কনডেন্স
মিল্ক-এর প্রচুর জনপ্রিয়তা রয়েছে।
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন।
পরিচিত
কেউ কাঠমাণ্ডুতে আছেন?
না।
আচ্ছা, এখান থেকে কাঠমাণ্ডু কতক্ষণের পথ?
আমার প্রশ্ন।
বেশি
না, ১০/১২ ঘন্টার পথ, কিন্তু আপনি আগামীকাল যেতে পারছেন না।
কেন, কী সমস্যা? মনে মনে ভাবছি, একা এসেছি, এরা আবার কোন
সমস্যা করবে না তো, আর আমার সাথে যে বেশকিছু টাকা আছে টের পেয়ে যায়নি তো !
হোটেলে ছিলাম না, মাস্টার কী দিয়ে ঘর খুলে ...। এছাড়া এখন পর্যন্ত আমি ছাড়া
আর অন্য কোন বোর্ডারকে দেখিনি। রাতে না আবার আমার সানডে-মানডে ক্লোজ করে দেয়!
আপনার
কাঠমাণ্ডু টিকেট কাটা আছে?
হ্যাঁ
বলবো, না না-বলবো বুঝতে পারছি না। সত্যই বললাম, না টিকেট কাটা নেই।
কাঠমাণ্ডুর
জন্য একদিন আগে টিকিট কাটতে হয়; আপনার টিকেট লাগলে আদিনাথকে জানাবেন আমি ব্যবস্থা করে দেবো— সেই ছোকরা
ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল।
এখন
বুঝলাম ব্যাটা টিকেট বেঁচে কিছু রোজগার করবে। ব্যাটা ধান্ধাবাজ। বললাম, আমি কী নিজে
টিকেট কিনতে পারবো না? বাচ্চাটি হঠাৎ চিৎকার দিয়ে কান্না করতে লাগল; শান্ত করতে
তরুনীটি পায়চারি শুরু করল।
হ্যাঁ, আপনি কিনতে
পারেন, কিনলে দাম দ্বিগুণ পড়বে, ‘ব্ল্যাকমার্কেট’
বুঝলেন। আর হ্যাঁ, ভালো সিটের
জন্য সকালে টিকেট কাটতে হয়, নয়ত ভালো সিট মিলবে না। গাড়ি কিন্তু ছাড়ে রাত তিনটা/সাড়ে
তিনটায়।
তাহলে
আমাকে আগামীকাল রাতের টিকেট কাটতে হবে,
বলে ডেভিডের দিকে তাকাই; সে টিভি’র রিমোট
কন্ট্রোল নিয়ে ব্যস্ত।
আজ বন্ধ
(হরতাল) ছিল, কয়েকদিন যাবতই এমন চলছে; কাঠমাণ্ডু’র দিকে খুব খারাপ অবস্থা ! অনেক খুনোখুনি হচ্ছে। আমার দিকে
না তাকিয়েই বলল ডেভিড।
ইস্।
তাই !
আসার
সময় হয়তো আপনি কিছুই বুঝতে পারেননি, না?
না, বুঝিনি। আসার
সময় আমার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকা লোকগুলোর মুখ আর আমার দিকে তাকিয়ে থাকার কারণ
এখন কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি।
আজ
প্রায় মাস হতে চলেছে ব্যবসা নেই, বাড়ি ছেড়ে হোটেলেই থাকছি। কোন বোর্ডার নেই, ব্যবসা নেই।
প্রায় এক সপ্তাহ পর আপনি আমার একমাত্র বোর্ডার। আগে বাংলাদেশের যাত্রীদের ভিড়
থাকতো, যারাই আসত অনায়াসে দু’চার দিন থাকত,
কিন্তু এই অস্থিরতায় সেটাও বন্ধ। ডেভিড
আদিনাথের দিকে উদ্দেশমূলক তাকায়।
আদিনাথ
মিনিবার থেকে একটি বিয়ারের বোতল নিয়ে টেবিলে রাখে, মেয়েটি বাচ্চা নিয়ে ভিতরের দিকে
চলে গেল, তবু বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
ডেভিড
টিভির Volume বাড়িয়ে দিল, টিভিতে নেপালী ভাষায় কী বলছে বুঝতে পারছি না, তবু টিভির
দিকে তাকালাম। সেই সময় ব্রেকিং নিউজ বলে কোন স্ক্রলিং টিভিতে আসতো না, আর আসলেও
বুঝতে পারতাম না, বড় বড় দেব নাগরী বর্ণে কী যে লেখা দেখাচ্ছে কিছুই বুঝতে
পারছি না।
ডেভিড
বলল, আগামীকালও আপনার যাওয়া হবে না,
মাওবাদীরা তিনদিনের পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে
আর সরকার নিরাপত্তা জোরদার করছে। এর পর ডেভিড যে কথা বলল, তার যেটুকু
মনে আছে—
কয়েকদিন
ধরে খুবই বাজে অবস্থা, মাওবাদী সন্দেহে কয়েকদিন আগে ১৪ জনকে হত্যা করেছে সেনারা, দুইজন মাওবাদী
গনেশকে কাঠমাণ্ডুতে মেরে ফেলেছে (শুধু গনেশ নামটুকুই মনে আছে, পুরোনামটিই
বলেছিল; গনেশ মাওবাদীদের বিরুদ্ধ নেতা),
নেপালের সরকারের অনুরোধে ভারতীয় সরকার
ভারতের লক্ষ্ণৌতে দু’জন মাওবাদী কেন্দ্রিয়-নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাদের কাছে
হস্তান্তর করে, তারপর মাওবাদীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। মাওবাদীরা কাঠমাণ্ডুর অদূরে
পর্যটকদের এক হেলিকপ্টারে গুলি করে যদিও কোন হতাহত হয়নি, এর দু’একদিন পরে
সরকার ৬৫ জন সন্দেহভাজনকে হত্যা করে, দু’জন সন্দেহভাজন মাওবাদী প্রাক্তন নেপালী পার্লামেন্টের এক
সদস্যকে হত্যা করেছে এছাড়া আরও অনেক কথাই বলেছিল, যা আছ স্মৃতির মনিকোঠায় বিস্মৃত
রয়েছে, আর কোনদিন ফিরে পাবো সেই আশা নেই। এখন যা বলছি তাও বহু কষ্টে স্মৃতি
হাতড়ে বলতে হচ্ছে।
স্তব্দ
হয়ে শুনলাম। আমার চিন যেতে হলে এখানে তিনটি দিন অপেক্ষা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।
রাতে খাবো কিনা, ডেভিড জানতে চাইল,
খাবো না বলে ঘরের উদ্দেশ্যে দাঁড়ালাম; ডেভিড অভয়
দিয়ে বলল, দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই,
ভারতীয় বর্ডার কাছেই আপনি অনায়াসে ফেরত
যেতে পারেন।
বিয়ারের
বোতল দেখিয়ে বলল, অভ্যাস আছে? চলবে?
আমি
বলল, না; সংক্ষিপ্ত উত্তর। হয়তো সে বুঝতে পারলো আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে, সে বলল, তাহলে রেস্ট
নিন, সকালে কথা হবে। শুভ রাত্রি।
অর্ধেক
রাত ছটফটে কাটলো, বাকি অর্ধেক ঘুমে। সকালে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম, আমার ওঠার
আওয়াজ পেয়ে আদি ঘরে নক করলো। সাব চা, কফি কুছ লাগে গা?
চায়ে, দশ মিনিট বাদ লে আনা। ঠিক হ্যাঁয়
বলে চলে গেল। আমি প্রাতঃক্রিয়াদি সেরে বারান্দায় বসে নিঝুম নিরব কাঁকড়ভিটা দেখছি
একটি মানুষও রাস্তায় নেই। আদি এসে চা দিয়ে গেছে, আমি সিগারেট ধরিয়ে চায়ে মুখ দিতেই
বমি আসতে চাইলো। একি! এটা চা না অন্যকিছু?
এত ঝাল কেন? এরা কী আমাকে
মেরে ফেলবে নাকি! আদি ! আদি ! নিস্তব্ধ কাঁকড়ভিটায় যেন একটি শব্দই চারপাশে
প্রতিধ্বনিত হলো, আদি; আদি।
দৌড়ে
এসে বলল, জি সাব।
এ
ক্যায়া হ্যাঁয়।
চায়ে।
এ চায়ে?
জী, সাব!
কাল যো
পিয়াথা ও ক্যায়া থা?
ও ভি
চায়ে!
ইতনা
কারাক অর তিখা কিউঁ?
আচ্ছা
সাব, আভি সামাজমে আয়্যা!
সুভে
কা চায়ে মে হামলোগ থোরাসা মিরচি দেতে হ্যাঁয়।
মুছে এ
চায়ে নাহি চাহিয়ে, কাল যায়সা চাহিয়ে,
লেকে আও।
বুঝলাম
এরা সকালের চায়ে গুড়া মরিচ দিয়ে খায়। মরিচ দেওয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরে বলেছে, মরিচ দেয়া চা
সকাল সকাল শরীরকে চাঙ্গা করে। যদিও পরে কাঠমাণ্ডুর সকালের চায়ে গুড়া মরিচ, বাঁটা মরিচ
কোনটি পাইনি।
আমি
সিদ্ধান্ত নিলাম যে কাজে বের হয়েছি তা শেষ করেই বাড়ি ফিরবো। তাই তিনদিন অপেক্ষার
বড়ি স্বাচ্ছন্দে খেলাম। কাঁকড়ভিটা পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে আর ক্যারাম বোর্ড খেলা
দেখে প্রথমদিন কাটিয়ে দিলাম। হোটেলের অদূরে একটি পাড়ায় রাস্তার পাশে প্রচুর
ক্যারাম খেলা হয় এবং বিভিন্ন বয়সীরা ক্যারাম খেলায় ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়।
দ্বিতীয়দিন
খুব গরম পড়েছিল, দুপুরে বের হইনি। দুপুরে খাওয়ার পর ডেভিডের সাথে আলাপ হলো, আলাপে জানতে
পারলাম তার মা নেপালী, বাবা আমেরিকান। সে বাবা-মার কাছে ভাগাভাগি করে থাকে, কিছুদিন
নেপালে কিছুদিন আমেরিকায়। সে সুযোগ বুঝে জানিয়ে দিলো, যদি তার সাথে
আমার ব্যবসা করার ইচ্ছা থাকে, সে করতে চায়। তাকে বাংলাদেশ থেকে মাথার ক্যাপ আর হাফ
প্যান্ট এনে দিতে হবে। বিকেলে ধূলাবাড়ি-মার্কেটে গিয়ে কী রকম ক্যাপ আর প্যান্টের
চাহিদা তা দেখতে চাইলে যেতে পারি। যদিও ধূলাবাড়ি-মার্কেট আর যাওয়া হয়নি।
সেদিন
বিকেলে বারান্দায় বসে আছি, যে রাস্তাটি দিয়ে ইমিগ্রেশন করে এসেছিলাম সেদিক দিয়ে একটি
সাঁজোয়া যান হোটেলের দিকে আসছে; তার মধ্যে একজন সেনা স্ট্যানগান নিয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিক
দেখছে। সাঁজোয়া যানটি সামনে আসলে সেনাটি আমাকে উদ্দেশ্য করে কি যেন বলল বুঝলাম না, কিছুসময় নিলাম
বুঝতে; বুঝলাম, ভেতরে যেতে বলেছে,
আমি বারান্দার গেট বন্ধ করে ভিতরে চলে
আসলাম। গাড়ির চলে যাওয়ার শব্দে নিশ্চিত হলাম সেনা যান চলে গেছে । কিছুক্ষণ পর আদি
দৌড়ে এসে গেট নক করলো, সাব আপকো ডেভিড সাব বুলাতা হ্যাঁয়। আচ্ছা, যাও আরাহা হু।
নিচে
নেমে দেখি ডেভিডের সাথে দু’জন সেনা কর্মকর্তা। ডেভিড বলল, উনারা আপনার সাথে
কথা বলতে চায়। তাদের মধ্য থেকে একজনের অগ্নিদৃষ্টি বুঝিয়ে দিল, ডেভিডকে চুপ
থাকতে; ডেভিড চুপ হয়ে গেল, এর পর তাদের সামনে আর রা-টুকুও ও করেনি। ভিনদেশ এই রকম
পরিস্থিতির সম্মুখীন হব এমন দুঃস্বপ্ন কোনদিন দেখিনি । ভেতর ভেতর ভয়ে আমার অবস্থা
খুবই খারাপ; মনে হচ্ছে পুল-সেরাতের উপর দাঁড়িয়ে আছি, একটু এদিক-ওদিক হলেই কেটে কেটে
নিচে পড়ে যাবো। উপরে তা বুঝতে দিলাম না। দু’জন আমাকে সরিয়ে নিয়ে ডেভিড আর আদি থেকে আড়াল করল। প্রথম
প্রশ্নেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল।
আমরা
তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছি?
হ্যাঁ, যাবো। যদি
তোমাদের আপত্তি না থাকে।
তুমি
এখানে কী করছ?
আমি
কাঠমাণ্ডু যাবো, তিনদিনের ধর্মঘটের কারণে আটকে আছি।
তুমি
কী তোমার দেশে রাজনীতি করো?
না, আমি রাজনীতি
করি না। আমি ব্যবসায়ী, তোমাদের ঢাকাস্থ হাই কমিশনে ফোন করে আমার সম্পর্কে জানতে
পারো, সেখানে কাউন্সিল সেকশনে একজন অফিসার আমার ভালো বন্ধু, চাইলে আমি
তোমাকে ফোন নম্বর দিতে পারি। ফোন নম্বর দেবো?
তোমাকে
যা জিজ্ঞেস করা হয় তার উত্তর দাও, তার বেশির না।
আমার
সম্পর্কে তোমাদেরই একজন বললে ভালো নয় কি?
কী ভাবে সেদিন আমার মুখ দিয়ে কথাগুলো বের
হয়েছিল, আজও ভেবে উত্তর পাই না।
পাসপোর্ট
সাথে এনেছ?
না, সাথে নেই, রুমে।
চল, পাসপোর্ট
দেখাবে।
দু’জনই আমার সাথে
উপরে চলে আসল, গেটে দাঁড়িয়ে বলল নিয়ে এসো।
পাসপোর্টের
ছবির সাথে চেহারা বারবার মিলিয়ে, ভিসার পাতাটি সূক্ষ্ণভাবে পরখ করে দু’জন নিজেদের
মধ্যে আলাপ করলো। বলল, নিচে চল!
নিচে
নেমে দেখি ডেভিড আর আদি আগের জায়গাই দাঁড়িয়ে আছে, একচুলও নড়েনি। ডেভিডকে তারা কি
যেন বলল বুঝলাম না। আমাকে বলল, তোমাকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি না, সাবধানে থাকবে। তাদের সন্দেহ দূর
হয়েছে, মনে হলো সন্তুষ্ট মনেই তারা চলে গেল।
ডেভিড বলল, আপনি এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন। এরা দু’জন ‘ভৈরব নাথ’। নেপালের এলিট স্পেশাল ফৌর্স, মাওবাদীদের চেয়ে কোন অংশে ভয়ঙ্কর কম নয়। IDF (Israel Defense Forces) দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। RNA-এর ট্যালেন্টদের নিয়ে এই ‘ভৈরব নাথ’ গঠিত। আপনি একটু দেরি করায় ওদের সন্দেহ হয়েছে, আপনি নামার আগে আমাকেও ওরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কাঠমাণ্ডুর অবস্থা খুব গরম, খুন-খারাবি বন্ধ নেই, টিভিতে এগুলো দেখায় না। দশটি ঘটনা ঘটলে টিভিতে একটি দেখায়। রাজা শা.. কু.. ..চ্চা (জঘন্য ভাষা গালি দিলো ডেভিড) নিজে বেশি সুবিধার নয়, তেমনি সুবিধাজনক অবস্থাতেও নেই। সে অনেক অন্যায় বানিজ্যের সাথে জড়িত, বিশেষ করে গাছ কাটা আর প্রাচীন মূর্তি বিক্রি করার সাথে। প্রজাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে; তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললেই মরতে হয়। ডেভিড যখন কথাগুলো বলেছিল, সে হয়তো নিজেও জানত না যে, নেপালের শেষ রাজা সম্পর্কে সে কথাগুলো বলে যাচ্ছে; নেপাল তার ঐতিহ্যবাহী রাজতন্ত্রই হারিয়ে ফেলবে অদূর ভবিষ্যতে।সেদিন আর বের হলাম না।
ডেভিড
বলল, আপনি এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন। এরা দু’জন ‘ভৈরব নাথ’। নেপালের
এলিট স্পেশাল ফৌর্স, মাওবাদীদের চেয়ে কোন অংশে ভয়ঙ্কর কম নয়। IDF (Israel Defense Forces) দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। RNA-এর ট্যালেন্টদের নিয়ে এই ‘ভৈরব নাথ’ গঠিত। আপনি
একটু দেরি করায় ওদের সন্দেহ হয়েছে, আপনি নামার আগে আমাকেও ওরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কাঠমাণ্ডুর
অবস্থা খুব গরম, খুন-খারাবি বন্ধ নেই,
টিভিতে এগুলো দেখায় না। দশটি ঘটনা ঘটলে
টিভিতে একটি দেখায়। রাজা শা.. কু.. ..চ্চা (জঘন্য ভাষা গালি দিলো ডেভিড) নিজে বেশি
সুবিধার নয়, তেমনি সুবিধাজনক অবস্থাতেও নেই। সে অনেক অন্যায় বানিজ্যের সাথে জড়িত, বিশেষ করে গাছ
কাটা আর প্রাচীন মূর্তি বিক্রি করার সাথে। প্রজাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে; তার অন্যায়ের
বিরুদ্ধে কথা বললেই মরতে হয়। ডেভিড যখন কথাগুলো বলেছিল, সে হয়তো নিজেও
জানত না যে, নেপালের শেষ রাজা সম্পর্কে সে কথাগুলো বলে যাচ্ছে; নেপাল তার
ঐতিহ্যবাহী রাজতন্ত্রই হারিয়ে ফেলবে অদূর ভবিষ্যতে।
সেদিন
আর বের হলাম না।
পরেরদিন
সব স্বাভাবিক হয়ে গেল, একটু মেঘলা আকাশ,
ধূসর দিন, ধূসর মন, ধূসর
কাঁকড়ভিটায় কিছুই করার নেই। হোটেলে ডেভিডকে দেখলাম না, বের হলাম। দু’একটি মুদি
দোকান ছাড়া সব দোকানপাটই বন্ধ, রাস্তায় লোক-জন একেবারে নেই বললেই চলে। মনে হচ্ছে অস্থিরতা
বৃদ্ধি পেয়েছে; একেবারে সীমান্ত এলাকা বলে হয়ত এখানে তেমন কোন আঁচ পাওয়া যায় না।
হাঁটছি সেই ক্যারাম পাড়ার দিকে, মেইন রোডে সেনা যান দেখা যাচ্ছে, সেইদিক দিয়ে
না গিয়ে গলিপথে এগুচ্ছি, ছোট জায়গা একদিনেই মোটামুটি চিনে নিয়েছি। ক্যারাম পাড়ার
রাস্তায় কোন ক্যারাম খেলা হচ্ছে না, কয়েকটি বাড়ির বারান্দায় ক্যারাম খেলা হচ্ছে, কিছু সময়
সেখানেই কাটিয়ে দিলাম। টিকেট কেনার ব্যাপারটি মাথায় ছিল না, যখন মনে পড়ল, দৌড়ে গেলাম
হোটেল।
হোটেলে
গিয়ে ডেভিডকে পেলাম, বললাম, আজ রাতে তো কাঠমাণ্ডুর গাড়ি যাবে?
হ্যাঁ, তুমি কি আজ
যাবে?
হ্যাঁ!
তোমাকে
বলেছিলাম সকাল সকাল বলতে, দেখছি কী করা যায় ! তিনদিন বন্ধের পর টিকেটের বেশ চাহিদা
তবু ...। তখনই সে দু’তিন জায়গায় ফোন করল,
ফোন রেখে বলল সব টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে।
তোমার মনে হয় আজও যাওয়া হচ্ছে না। যদি ভাগ্য ভালো থাকে সন্ধ্যার পর
ব্ল্যাকমার্কেটে তুমি টিকেট পেলেও পেতে পার। ততক্ষণ অপেক্ষা করো, আর এর মধ্যে
যদি আমি জোগার করতে পারি তোমাকে জানাবো।
নিজের
প্রতি নিজের এত রাগ হলো যে দুপুরে খেলাম না,
সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করছি। সন্ধ্যা
পর্যন্ত রুমেই থাকলাম । সন্ধ্যায় গেলাম টিকেটের খোঁজে, কোন টিকেটই
নেই। আধ ঘন্টা ঘুরাঘুরি করে টিকেট না পেয়ে নিরাশ হয়ে হোটেলে ফিরলাম। ডেভিড আমাকে
দেখে বুঝল, টিকেটের জন্য গিয়েছিলাম। বলল,
ভাগ্য ভালো হলে পেয়ে যাবে; চিন্তা কর না।
আমি কিছু না বলে উপরে উঠে গেলাম।
চায়না
যাওয়ার পথে আজ তিনদিন বসে আসি প্রায় ভারতে (ভারত-নেপালের সীমান্তে), বসে বসে সময়
নষ্ট করছি। মনের উপর চাপ বাড়ছে। নিজ হাতে কোন উপায় নেই। রিক্ত হৃদয়ে শূণ্য ঘরে একা
আমি। একলা-মনে যন্ত্রণার অনুভূতি যেন বেড়ে যায়; একটাকার যন্ত্রণায় দুই টাকার
অনুভূতি। মেজাজ গিয়ে পড়ল মাওবাদীদর উপর,
এই ব্যাটাদের কারণে আমার তিনদিনের কষ্ট, টাকার
শ্রাদ্ধ। টিভি দেখতে বৃথা চেষ্টা করলাম। না,
মন বিক্ষিপ্ত হয়ে কঠিন হয়ে গেছে, সব জেদ চেপেছে
বিদ্রোহীদের উপর। মনকে তরল করতে হবে, না হয় আগামীকালই নিজ বাড়ীতে আমাকে দেখা যেতে পারে; শক্ত কিছু না।
কঠিন মনে চায়না যাওয়া হবে না। উপায় একটি বের করলাম— বিদ্রোহীদের মন খুলে মনে মনে
গাল-মন্দ করা।
গালাগালি
দিতে গিয়ে সমস্যা হলো এদের কাউকে আমি চিনি না, জানি না, দেখি নাই
কোনকালে। গালি দিতে গেলে মনের মধ্যে একটি মূরতি আঁকতে হয়, কার মূরতি
আঁকবো ? শত চেষ্টায়ও সম্ভব হলো না,
মনে মূরতিই তো নেই।
নিজের
ক্ষুব্ধ মন হঠাৎ জটিলতার মোড় থেকে সহজ পথ ধরলো কারণ- তিনদিনের কষ্টে যদি আমার মন
এতো বিক্ষুব্ধ, উত্তেজিত হতে পারে, তবে যারা যুগ যুগ ধরে বৈষম্য, বঞ্চনা, নিপীড়ন, শোষণের শিকার
তাদের বিদ্রোহ করার অধিকার সর্বাগ্রে,
আমার সাময়িক কষ্ট, বিরক্ত, অস্বস্তি, যন্ত্রণা অতি
তুচ্ছ।
সভ্যতার
দিকে তাকালে দেখা যায়, সমসাময়িকে সবগুলো সভ্যতারই সভ্যদের (আধুনিক, জ্ঞানী) হাতে
জন্ম। সভ্যদের অনেক ভালো বৈশিষ্ট্য থাকলেও,
একটি অন্যতম মন্দ বৈশিষ্ট্য হলো
মৃত্যু-ব্যবসা। যুদ্ধ একটি বিশুদ্ধ মানুষ্যঘটিত ব্যাপার। ইতর প্রাণিরাও
দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়— যৌন তাড়নায়, ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে বা কখনো কখনো খেলার ছলে। মানুষই
একমাত্র প্রাণি যে স্বজাতীয় প্রাণিদের পাইকারী হারে হত্যা করে।
এমন
সাত-পাঁচ যখন মনের ভেতর চলছে, তখন রুমের দরজায় নক করার শব্দ। গেট খুলে দেখি আদি।
ক্যায়া
?
সাব
আপকো বুলাতা হ্যায় !
কিস
লিয়ে ?
পাতা
নাহি !
যাও, আরাহা হু ।
নিচে
গেলে, ডেভিড বলল আজ রাতের একটি টিকেট পাওয়া গেছে, তবে সামনের
সিট হয় নি। দাম একটু বেশি, ৫৫০ রুপি। আশা করছি,
৫০০ রুপি করা যেতে পারে !
তাই
দেখো।
আমার
সামনেই ফোন করে টিকেট কনর্ফাম করা হলো।
জিজ্ঞেস
করলাম, কোন সিট ?
এখনো
সিওর করা যাচ্ছে না, তবে একটি সিট পাওয়া যাবে; সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে গাড়ী ছাড়বে
ভোর ৪টায়।
রুমে
এসে যাওয়ার সব প্রস্তুতি শেষ করলাম। গাড়ী ছাড়বে ভোর ৪টায়। এখনও অনেক সময় বাকি। আধ
পেট খেয়ে নিলাম, ভরপেটে ভ্রমণে আমার কষ্ট হয়। খাওয়ার পর চা খাচ্ছি, এমন সময় ডেভিড
এসে পাশে বসল। আমাকে একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলল, কাঠমাণ্ডুতে কোন সাহায্যের দরকার
হলে ওর সাথে যোগাযোগ করো; আমার ভালো বন্ধু,
তোমাকে সাহায্য করবে।
এখানে
উল্লেখ করা হয়নি, এই দুই-তিনদিনে ডেভিডের সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সে
রুম ভাড়া আমার কাছে থেকে কম নিয়েছে।
বললাম, ধন্যবাদ।
যে
তিন-চার ঘন্টা হাতে আছে ঘুমিয়ে নাও। আমি যাওয়ার সময় তোমাকে ডেকে দেবো বলে ডেভিড
মিনি-বারের দিকে এগিয়ে গেল। এখন ওর সুরাপানের সময়, তারই আয়োজন চলবে।
রুমে
গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। তন্দ্রা মতো হলেও ঘুম আসছে না। বন্ধ খাঁচা থেকে মুক্তির
আভাস আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। তবু কখন যে চোখের দুই পাতা এক হয়েছে বুঝতে পারলাম
দরজায় ধাক্কার আওয়াজে। ধরমড়িয়ে উঠলাম ।
গেট
খুলতেই সেই আদি।
সাব
যানেকে টেইম হো গ্যায়া।
হা, আতা হু।
বাস
টার্মিনালে গিয়ে দেখি প্রচুর মানুষ। বোঝা যাচ্ছে যাত্রী ছাড়াও অন্যরা বিদায় দিতে
এসেছেন। যে বাসটিতে আমার বসবার সৌভাগ্য হয়েছে তা দেখে আমার প্রায় কান্না এসে গেল।
এমন বাস তো ঢাকায় আরও বিশ বছর আগে দেখেছি। মোমেন কোম্পানীর ‘মুড়ির টিন’। ‘৪৭ সনে ভারত
ভাগের সময়ের ছবিগুলোতে এমন বাসই দেখা যায়। নিরুপায়ের এইটাই উপায়।
আমাকে
বিদায় দিতে আদি, ডেভিড আর বাচ্চাসহ ঐ তরুণীটি এসেছে। তিনদিনে একটা
পারিবারিক সম্পর্কের মতো হয়ে গেছে। অবাক ব্যাপার বিদায় নিতে সত্যই কষ্ট হচ্ছে।
তখনও
বাসে উঠি নি, বাসের কন্ডাক্টারের সাথে ডেভিড অনেকক্ষণ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করলো; ডেভিড নিজেই
বলল, ব্যাটা বজ্জাত, সবার পেছনে সিট দিয়েছে, আমি এর বারোটা বাজাবো। সিটটি সবার
পেছনের হাতের বামে জালানার পাশে। বললাম,
থাক বাদ দাও, বারোটা বাজাতে
হবে না। আমি খুশিই আছি।
ডেভিড, আদি তারা চলে
গেল; যাওয়ার আগে ডেভিড আবার বললো মাত্র ১০/১১ ঘন্টার যাত্রা একটু কষ্ট হবে, মানিয়ে নিও।
তাকে
অভয় দিয়ে বললাম, কোন সমস্যা নেই;
জানালার পাশে সিট হওয়াতে ভালো হয়েছে, সব দেখতে
দেখতে যাওয়া যাবে।
ঘন
অন্ধকারে যাত্রা শুরু হলো। রাতের বেলা ভ্রমণে গাড়ির সামনের দিকে সিটে বসলে রাস্তার
দু’ধার দেখার সুবিধা পাওয়া যায়,
এই যাত্রায় বঞ্চিত হলাম। তবু
জানালা-লাগোয়া সিটে ঘোলে মিটালাম দুধের স্বাদ। গাড়িতে উঠলেই ঘুমের ছুটি। চোখ
গোগ্রাসে দৃশ্য গিলতে থাকে।
টার্মিনাল
থেকে একসাথেই সব গাড়ি ছাড়লো। আমাদের গাড়িটি মাঝামাঝি রয়েছে, গতিও
মাঝামাঝি। পাঁচ-ছয় মিনিটেই রাস্তায় একটি বাজারের মতো দেখলাম। গ্রাম্যবাজার রাতে
দেখতে যেমন হয়— বন্ধ কাঠের গেটওয়ালা দোকানগুলোর সামনে একটি ১০০ ওয়াট বাল্ব জ্বালানো, কোনটির
সাইনবোর্ড আছে, কোনটির নেই; দু’চারটি ছন্নছাড়া কুকুরের ঘোরাঘুরি, কোথাও ময়লার
স্তুপ, একটি ব্যাংকের সাইনবোর্ড দেখে বুঝলাম— ধুলাবাড়ি। এখানেই ডেভিড নিয়ে আসতে
চেয়েছিল।
কিছুদূর
পরেই এক-দেড় কিলোমিটারের মতো রাস্তার দু’পাশে জঙ্গলের মতো শুরু হলো। গাড়ির আলোতে বোঝা যাচ্ছে
গাছগুলো বেশ লম্বা লম্বা, তাদের মোটা মোটা ধড়;
সেগুলোর মাথা দেখতে হলে নিজের মাথা
জানালার বাইরে নিতে হয়। আমাদের গাড়িটাই শুধু মোমেন কোম্পানীর মুড়ির টিন নয়, এমন আরও
কয়েকটা গাড়িই দেখা গেল।
আবছা
আঁধারে একসময় রাস্তার দু’পাশে ছোট ছোট টিলার মতো দেখা গেল, ঠাণ্ডা বাতাস
তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। জানালা আটকানোর চেষ্টা করে বুঝলাম জানালায় সমস্যা, আটকানো যাচ্ছে
না। কাপড়সহ ব্যাগ বাসের পাকস্থলিতে। ভেজা বাতাসে শীত করছে। শীত সহ্য আমার জন্য
কষ্টকর কিন্তু নিরুপায় ! পাশের সিটে শুকনো হার জিরজিরে মধ্য বয়সী যাত্রী; ঘরের সমস্ত
জিনিস নিয়ে বসে আছে। কোলের উপর দু’টি বস্তা সাইজের ব্যাগ। পায়ের নিচেও একটি মোটা কাপড়ের তৈরী
মালপত্রে পূর্ণ ব্যাগ, গাড়ির পাকস্থলিতে কয়টা কে জানে।
টিলার
রাস্তা শেষে গাড়ি কিছুক্ষণ চলল ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে। আলোর আভাস আকাশে। আমরা
উত্তর দিকে যাচ্ছি, আমি সর্ববামে বসা। সূর্য আড়মোড়া দেওয়া শুরু করেছে, ধূসর পরিস্কার
আকাশ নিজের বর্ণ পরিবর্তনের খেলা শুরু করেছে মাত্র, অচেনা-অজানা পাখির ঝাঁক উড়ে
যাচ্ছে কিচিমিচির করে। প্রকৃতি এটা নৈসর্গিক রূপধারণ করেছে ; আস্তে আস্তে
অন্ধকার হারাতে লাগলো, কোথায় লুকাবে তাতেই ব্যস্ত। জঙ্গলের মধ্য থেকে একপাল
বনশুকর সশব্দে রাস্তা পার হলে গাড়ি কিছুক্ষণ থেমে রইল, ছোট-বড় মিলিয়ে
তাদের সংখ্যা ‘শ এর উপর। জঙ্গলের রাস্তায় গাড়ির গতি এমনিতেই কমে গেছে। জঙ্গল থেকে
ভেসে আসা নানান কল কূজন, সূর্যের তেজহীন সোনালি আলো, গাছের পরিস্কার সতেজ সবুজ পাতা
চোখকে আরাম; রাতে না-ঘুমানো ক্লান্তিকে নাশ আর শরীর-মনকে চাঙ্গা করলো । জঙ্গলের
পথটি শেষ হলো ১০/১২ মিনিটে। সুন্দর একটি সকাল উপভোগ করতে পারলাম। কিন্তু পেট বলছে
অন্য কথা। পেটে ভুখে ট্রাম্পেট বাঁজছে। জঙ্গলের রাস্তা শেষে গাড়ি দিলো টান। একটানে
আর্মির চেকপোস্ট।
গাড়ির
কন্ডাক্টর সবার উদ্দেশ্যে কি যেন বললো ! একে একে সবাই নিজ জিনিস-পত্র নিয়ে লাইন
ধরে চেকপোস্টের দিকে যাচ্ছে। আমিই বাসের সবচেয়ে কম পণ্যবাহক। আগের গাড়ির যাত্রীদের
বিরাট লাইন, কম করেও দু’আড়াইশ মিটার লম্বা হবে। এমন লাইন জীবনে প্রথম দেখলাম, সোজা নয়; সাপের মতো
আঁকাবাঁকা, দু’পাশে বুক সমান কাঁটাতারের রোল,
যাত্রীরা তার মাঝখান দিয়ে লাইন দিয়েছে ।
কোন অপরাধী দৌড়ে পালাতে চাইলে গুলি করার দরকার পড়বে না; কাঁটাতারেই
আটকে গিয়ে শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। আর্মিগুলো সব পিচ্চি পিচ্চি, মনে হয় এলাকার
ছোট ভাই। তাদের হাতের বস্তুটি যেকোন সাহসী মানুষকে মুহূর্তে কাবু করতে সক্ষম।
সকালের বিশুদ্ধ আলোতে কালো সমরাস্ত্রটি চকচক করছে, বেশি বড় না, দেখে হালকা
মনে হচ্ছে, অস্ত্রের সাথে ছাই রঙের কাঁধে ঝোলানো ফিতাটি পর্যন্ত চকচকে। বাংলাদেশের
আর্মিদের কাছে একই বস্তু অনেক পরে দেখেছি। গাঢ় খয়েরি আর গাঢ় সবুজ রঙের পোশাকে
ফিটফাট, শ্যেন-দৃষ্টি প্রতিটি যাত্রীর উপর। যাত্রীদের মুখে বুলি নেই, সবাই বোবার
মতো একটু একটু করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে,
ডানে-বামেও তাকানোর কারোর ফুরসত নেই। মনে
আছে এখনও, ব্যাগ ধরে আমার হাত ব্যাথা হয়ে গিয়েছিল। কাঁটাতারের শেষ প্রান্তে বিরাট
একটি টেবিল, তাতে সবার ব্যাগ, পোটলা-পুটলি চেক করা হচ্ছে। যাদের সন্দেহ হচ্ছে তাদের অন্য
জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারো কারো ব্যাগ রেখে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, এইসব দেখতে দেখতে
আমার পালা আসল। আমি গেলে আমাকে নেপালি ভাষায় কি বলা হলো বুঝলাম না। আমি কথা না বলে
পাসপোর্টটা সেনা কর্মকর্তার হাতে দিয়ে ব্যাগের চেইন খুলে দিলাম। ব্যাগে সন্দেহজনক
কিছু না পাওয়ায়, সেনা কর্মকর্তাটি সন্তুষ্টিমূলক ‘ওকে’ বলে পরেরজনকে
ডাকলেন। বাসের খোঁজে চলে গেলাম। পরে জেনেছি জায়গাটির নাম ছিল দামেক। এমন আরও দু’বার আমাদের
চেকপোস্টের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। একবার মিথিলায় ডুকবার আগে, আরেকবার কোথায়
মনে নেই।
বাস
চলা শুরু করলো। পাশের যাত্রীর কোলে ব্যাগ একটি বেড়ে তিনটি হয়েছে। বসতে অসুবিধা
হচ্ছে। আমি একটু চেপে বসতে বলায় সহযাত্রী মনোক্ষুন্ন হলেন। অন্য দেশিভাইদের সাথে
মুখ বেঁকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কী যেন বলছেন,
কিছুই বুঝতে পারলাম না। কথার মাঝে শুধু ‘বাঙালাদেশ’ শব্দটি বুঝতে
পারলাম। চাপলো তো নাই, বরং ভিন্ন ভাষায় গালাগালি খেলাম কিনা কে জানে ! পেটে
রাজ্যের ক্ষুদা নিয়ে বসে আছি। একটু যেতেই একটি চায়ের বাগান পড়ল, বেশ বড়। চা
বাগান দেখে সকালের চা না খাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল। রাত থেকে না খাওয়া। সকালে থেকে
আর্মির চেকের পর একটি সিগারেটের স্বাদ পেয়েছি, মাত্র তিনটি সিগারেট পুঁজি। এরা
অনেকেই বাসে সিগারেট খাচ্ছে। সকালের নাস্তাটি আমি চেকপোস্টের ওখানে সেরে নিতে
পারতাম। নিজের ভুল কাউকে বলার নেই। অবশ্য বাসে উঠার পর থেকে যতটুকু বাক্যব্যয়
হয়েছে তারজন্য বাঁকাচোরা চোখমুখ দেখতে হয়েছে। আমার নিরব থাকতে হলো।
রাস্তায়
আবার একটি জঙ্গল পড়লো; এটি আগেরটির চেয়ে বড় এবং ঘন। অবশ্য আগেটি রাতে দেখেছি বলে
ঠিক তুলনা করা চলে না, তবু মনে হলো তারচেয়ে ঘন। জঙ্গলের রাস্তাটি শুরু হলো একটি
পুরোনো পুলের পর, গাছগুলো বেশ উঁচু উঁচু, পাশাপাশি। পাঁচ/দশ মিনিট যাওয়ার
পর একটি বিরাট ঝিলের মতো শুরু হলো, নানান রঙের পাখির ঝাঁক, তাদের ঝাঁপটা-ঝাঁপটি দেখতে দেখতে
চলছি। রাস্তার সাথে সাথে ঝিলটি কিছুদূর যাওয়ার পর ডানদিকে মোড় নিল। পরের রাস্তায়
ক্রমে গাছের ঘনত্ব কমা শুরু করেছে, একসময় জনবসতি দেখা গেল। কিছু দোকানপাট, ইট-সিমেন্টের
ঘরবাড়ি, লোক সমাগম দেখে ভাবলাম জঙ্গলের পথ শেষ। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময়
শরীরটা যেন কেমন হয়ে যায়। যান্ত্রিকতা আর কৃত্রিমতাহীন মনোরম পরিবেশ, পেটে
দানা-পানি থাকলে হয়তো আরও মনোরম মনে হতো। জায়গাটির নাম বেলবাড়ি। আমি জায়গার
নামগুলো কিন্তু সব পরে জেনেছি। কাঠমাণ্ডুতে গিয়ে একজন নেপালি’র সাথে
বন্ধুত্ব হয়, তাকে আমার এই ভ্রমণ কাহিনী শুনিয়ে আমি জায়গার নামগুলো উদ্ধার করি। সে
আমার এই ভ্রমণকাহিনীর প্রথম পাঠক না শ্রোতা ?
জনবসতি
একসময় শেষ হয়ে আবার শুরু হলো জঙ্গল, বুঝলাম জঙ্গলের মধ্যেই বসতি। এখন জঙ্গলের ঘনত্ব আগের অংশের
চেয়ে বেশি। এখানটায় বড় বড় পাতাওয়ালা অজানা গাছ বেশি। একটা সময় বিরাট একটি বটগাছ
পড়ল, তার গায়ে লাল রঙের আঁকিবুকি দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না যে গাছটি অনেকের
কাছেই পূজা পায়। সূর্য প্রায় মাথার উপর আসতে আর দেরি নেই, গরম লাগা শুরু
করেছে। জঙ্গলের রাস্তায় বাতাসও তুলনামূলক কম। বানরের দল, হাতির পাল, বন শুকরের পাল
কয়েকবারই দেখা গেল। একটি নতুন পুলের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় নিচের শুকনো নদীর কাদাজলে
হাতির পালকে পানি খেতে দেখা গেল । গাড়ি যে কখন থামবে !
জঙ্গলের
রাস্তা শেষ হলে পর কিছু দূর সমতল; ক্ষেত,ঘর-বাড়ি, বাজার-হাট পেরিয়ে একসময় টিলার রাস্তা শুরু হলো। এখন টিলার
গায়ের উপর দিয়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি। একেকটি উচ্চতায় মোটামুটি ২০/২২ তলার মতো হবে।
এমন ২০/২৫টি পেরিয়ে বাস থামলো একটির নিচে,
ধাবা টাইপ খাবারের দোকানে। সূর্য তখনও
মধ্যগগনে যেয়ে পারেনি, প্রচুর তাপ। আকাশে হালকা মেঘ, মেঘের আড়ালে
সূর্য গেলে কিছুটা আরাম পাই। বোঝা গেল দুপুরের খাবারের বিরতি।
ধাবাটির
অবস্থা পছন্দ করার মতো নয়, তবু ক্ষুদার কারণে ঢুকলাম। ভাতের ব্যবস্থা আছে সাথে ডাল আর
তরকারি কিন্তু তাদের পরিবেশন আর রান্নার অবস্থা দেখে খাওয়া গেল না। সেখানে আরও
একটি খাবার দেখলাম নাম ডিডো, অনেকটা হালুয়ার মতো। একপাশে একটি থালিতে মম দেখা গেল
কয়েকটা, কিন্তু বিরাট বিরাট মাছি দলবেঁধে মানুষের আগেই স্বাদ নিচ্ছে, এ আর খাওয়া
যায় ! দার্জিলিঙের প্রথম মম খাই, খাবারটি ভিনদেশি হলেও আমার বেশ পছন্দের আর নেপালি মানুষেরা
বাঙালিদের মতো তিনবেলাই ভাত খায়। ভ্রমণে আমার আপদকালীন খাবার হচ্ছে বিস্কুট আর
কোকাকোলা, নো টেনশন ! নিরাপদে খাওয়া যায়। তা কিনে পেটের আগুন নিভালাম। ধারণা
করলাম কাঠমাণ্ডুর রাস্তার বেশি বাকি নাই;
গাড়িতে প্রায় ৭/৮ ঘন্টা হয়েছে, বাকি আছে আর
দুই আড়াই ঘণ্টা, যা খেলাম তাতে চলে যাবে। সিগারেট যারা খায় তারাই জানে এর
পিপাসা কী ? গাড়ি থেকে নেমেই একটি শেষ করেছি আর খাবার পর একটি। চা খেতে চেয়েও সম্ভব
হলো না ভাষার কারণে- টি, চা, চায়ে; না, কোনটাই বুঝলো না।
অনেকটা
পথ সমতল, যেন বাংলাদেশের রাস্তা দিয়েই যাচ্ছি। কোন পার্থক্য নেই। অনেকক্ষণ সমান
রাস্তায় গাড়ি চলে একটি ছোট শহরের ঢুকলো,
ততক্ষণে সূর্য পশ্চিম হালকা কাত হয়েছে; গাছপালা, বাড়িঘরের ছায়া
লম্বা হতে শুরু করেছে। পুরো রাস্তায় এই প্রথম একটি শহরের ঢুকলাম, ভাবলাম কাঠমাণ্ডু
এসে গেছি। আমার হিসেবে বিকেলের মধ্যে আমাদের কাঠমাণ্ডুতে থাকার কথা, তাই ভাবনাটা
খুব যুক্তিসংগত। পরে জেনেছি এই শহরটির নাম মিথিলা। আগেই বলেছি, এই শহরে
ঢুকবার আগে চেক হয়েছে। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে কিছুসময়ের মধ্যে ঘন কালো মেঘে
আকাশ ঢেকে গেল; দিনটি যে কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত এত সুন্দর রৌদ্রোজ্জল ছিল বিশ্বাস করা
যাচ্ছে না। এখানে একটি ব্যাপার ঘটলো আমাদের গাড়ি মিথিলা শহর ছেড়ে বামে পথ ধরলো, ৩০/৪০
কিলোমিটার গিয়ে এক জায়গায় ২/৪ মিনিট থেমে আবার মিথিলার দিকে রওনা হলো। ব্যাপারটি
তখন বুঝতে পারি নি। পরে জেনেছিলাম মিথিলার পরে কাঠমাণ্ডু যাওয়ার পথ দু’টি; প্রথমটিতে
রাস্তা বেশি কিন্তু প্রায় সমতলভূমি তাই যেতে সময় কম লাগে আর দ্বিতীয়টিতে রাস্তা কম
কিন্তু পাহাড়ি রাস্তা, সময় বেশি লাগে। সমতল রাস্তাটির কোন এক অংশ নদী বা পাহাড়
ঘেষা। রাস্তাটির সেই অংশ হয় নদীতে ধসে গেছে নয়তো পাহাড় ধসে পড়েছে তাই ঐ রাস্তা
বন্ধ; বিকল্প এখন পাহাড়ি রাস্তা।
ঝিরঝির
বৃষ্টি শুরু করেছে, গাড়িতে উঠেছি প্রায় ১১ ঘন্টা। বৃষ্টি থামে আবার শুরু হয়।
আমাদের গাড়ি পাহাড়ের রাস্তায়। কিছুক্ষণ আগে নিচে দেখা বাড়িঘরগুলো উপরে উঠতে উঠতে
ছোট হয়ে যাচ্ছে, খেলার মাঠগুলোতে যারা খেলা করছে উপরে উঠে দেখলে মনে হচ্ছে
পিপড়া দৌড়েছে। একেকটা পাহাড় উঠছি আবার সেই পাহাড় থেকে নেমে অন্য একটিতে উঠছি। নিচে
নামলে দু’চারটি বাড়িঘর, দু’চার জন মানুষের মুখ দেখা যায় বাকিটুকু বিরান। ক্ষুদায়
পেটের নাড়িভুড়ি পর্যন্ত জ্বলা শুরু করেছে,
বাকি কোকটুকুও খেয়ে শেষ করেছি। পেট ভরা
শুধু পানি আর পানি। আস্তে আস্তে পাহাড়ি রাস্তা ভয়ঙ্কর হওয়া শুরু করল, ভয়টা পাহাড়ের
মাথাতেই বেশি হয়। কিছু কিছু জায়গায় একটি গাড়িকে থামিয়ে অন্যটিকে যেতে দিতে হয়; আমাদের গাড়ি
এমনভাবে কয়েকবার সাইট দিলো যে মনে হয় গাড়ির চাকা শূণ্যে। পাহাড়ের উপরে গাড়ির গতিও
বেড়েছে। গাড়ির বাইরে চোখ দিলেই হৃদপিণ্ড কাঁপতে থাকে, চাকা থেকে
মাত্র দু’এক ইঞ্চি দূরত্বে রাস্তার শেষ কিনারা। নিচের বিরাট খাদ, একেক সময় উঁকি
দিতে মন চায় না, মনে হয় তাকালেই গাড়ি নিয়ে পড়ে যাবো। পাহাড়ের মাথায় ডান
দিকে মোড় নিতেই মনে হয় গাড়ির সামনের অংশ চলে গেলেও আমি পরে যাবো। রাস্তার পিচগুলো
ভাঙ্গাচূড়া, গর্তে ভরা। সেই ভাঙ্গা রাস্তায় কিনারা সই সই করে কয়েকবার গাড়ি চলল। যত
সহজে রাস্তার কিনারা ভেদ করে নিচের খাদ দেখা যাচ্ছে, তা গাড়ির চালকও দেখতে পারছে না
কারণ সে ডান পাশে বসা। ঝিরঝির বৃষ্টি নিয়মিত,গায়ের শার্ট পুরো ভিজে গেছে অনেকক্ষণ, শীতে কাঁপা
শুরু করলাম, ক্ষুদায় মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। একটা সময় প্রসাবের চাপ অনুভব করলাম, জানি না ভয়েই, না পানি বেশি
খাওয়ার কারণেই। অনেকক্ষণ চেপে রেখেছি,
একজনের জন্য গাড়ি থামবে বলে মনে হয় না।
গাড়ি বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ি রাস্তায় এত ভয়ঙ্করভাবে চলছে যে বেশির ভাগ মানুষের
চেহারায় স্পষ্ট একটা হতাশা আর আতঙ্কের ছাপ। ভাব, ভালোবাসা, ভয় বা আতঙ্ক
বুঝতে ভাষার প্রয়োজন হয় না। ভাষা ছাড়াও এগুলো সহজেই বোঝা যায়। বৃষ্টিতে ভেজা শরীর, পেট খালি, প্রচণ্ড
নিম্নচাপ আর ভয়ঙ্কর রাস্তায় ভয়ঙ্কর গাড়ি চলানো, উপরি হিসেবে ভাঙ্গা রাস্তার
ঝাঁকুনি; অবস্থা মারাত্মক করুণ। কোন মানুষকে বলতে পারছি না, আবার সহ্যও
করতে পারছি না। এই অবস্থায় থাকতে হলো আরও দু’ঘন্টা। শরীরের নিচের অংশের কলকব্জা ফেটে যেতে চাচ্ছে।
কিভাবে নিয়ন্ত্রন হয়েছে আজও জানি না, মনে পড়লে খুবই খারাপ লাগে।
১৫/২০টি
বা তারও বেশি পাহাড় অতিক্রম হলাম, সন্ধ্যা প্রায় হয় হয় এমন সময় পচা মাছের গন্ধ আসা শুরু করলো; অনেকক্ষণ ধরেই
কটূগন্ধটা আসতে লাগলো, গাড়ি যত ঘুরতে ঘুরতে উপরে যায় গন্ধের তীব্রতা তত বাড়ে।
গন্ধ, ক্ষুদা, নিম্নচাপ, ঝাঁকুনি আর ভেজা শরীর; সব মিলিয়ে আমি অসুস্থ হতে শুরু
করলাম। জাপানি সামুরাইদের আত্মহত্যার একটি পদ্ধতি আছে যার নাম হারা-কিরি বা
সাপ্পুকু। মাথায় তখন হারা-কিরি ঘুরছে,
যদি সাথে একটা টান্টো থাকতো, তাহলে
হারা-কিরি করতে সেকেণ্ড বিলম্ব হয়তো করতাম না, আমিই হতাম প্রথম বাংলাদেশি
টামেটোমো। সম্ভব হলো না আমার কাছে টান্টো নাই বা তদানুরূপ কিছুই নাই। একটা
দেয়াশলাই ছিল পকেটে তা বহু আগেই ভিজে মৃত। কন্ডাক্টারকে গাড়ি থামাতে বলবো, না বলবো না
এমন চলছে অনেকক্ষণ, এমন সময় হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করলো। ব্রেক করে গাড়ি থেমেই গেল।
গাড়ি স্থির থাকতে পারছে না, পেছনের দিকে চলছে যাত্রীদের মাঝে চিৎকার চেঁচামেচি। সামনের
দু’চারজন যাত্রী গাড়ি থেকে নেমে পরল। গাড়ির পেছনের চাকায় পাথর দিয়ে গাড়ি
স্থির করলো। আমি ছুটে নেমে পরলাম। বৃষ্টি তখনও হচ্ছিল সন্ধ্যার নিভু নিভু আলো।
এককোণে গিয়ে আগে হালকা হলাম, ধড়ে জীবন ফিরে পেলাম। শূন্য বিরান এই পাহাড়ের মাথায় আমরা
যাত্রী কয়জন মাত্র। তীব্র গন্ধে এলাকা ভরে গেছে। সামনে গিয়ে দেখি আড়া-আড়ি করা মাছ
ভর্তি একটি পোড়া লরি, ভিতর দুজন মানুষ,
পুড়ে ছাই। লরিটি সরু রাস্তায় এমনভাবে
রেখে জ্বালানো হয়েছে যে, কোন গাড়ির যাওয়া-আসা অসম্ভব। আমাদের যাত্রীরা লরির
কাছাকাছি গিয়ে দূর্গন্ধে ফিরে আসছে। লরি না সরানো ছাড়া যাওয়া অসম্ভব।
আরও
গাড়ির অপেক্ষা আমরা করতে লাগলাম। এগুলো সবই আমার চোখে দেখা থেকে বলছি, কারোর সাথে
আলাপের সুযোগ হয়নি কারণ কয়েকজনের সাথে আলাপের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি ওরা নেপালি
ভিন্ন অন্য ভাষা বুঝে না। হ্যাঁ, এখানে বলে রাখি মিথিলায় দু’জন ইউরোপিয়ান উঠেছে আমাদের
গাড়িতে। তারা গাড়ির ডানদিকের সেকেন্ড লাস্ট সিটে বসেছিল। দু’জনের সাথে
আলাপ হলো; যতটুকু আজ মনে আছে এরা জার্মানের নাগরিক, সাংবাদিক ছিল। ঘুরতে এসেছে নেপাল।
নেপালিদের চেয়ে এরা বেশি ভীত, দু’চার মিনিটের জন্য গাড়ির বাইরে এসে অবস্থা দেখে আবার নিজের
জায়গায় চলে গেল।
ঝিরঝির
বৃষ্টি থামছে না। আমাদের গাড়ির পেছনে ১৫/২০ মিনিটে গাড়ির লাইন লেগে গেল। আস্তে
আস্তে বাড়তেই থাকলো। কোন গাড়ি যদি হঠাৎ করে একটু পেছনে যায় তখন একটি ব্যাপার ঘটে।
ক্রমান্বয়ে তার পেছনের গাড়িগুলো হর্ণ বাজাতে বাজাতে পেছনের দিকে যায় মনে হয় একটাকে
টোকা দিলে অন্যগুলো আপনা-আপনি পেছনে চলে,
একসময় হর্ণের আওয়াজ পাহাড়ের গায়ে মিলিয়ে
যায়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে ততক্ষণে। সবাই মিলে লরি সরাতে চেষ্টা করছে কিন্তু এমনভাবে
আটকানো যে এদিক ওদিক হলেই পাহাড় থেকে পড়ে যেতে হবে। পাহাড়ের নিচে ঘন জঙ্গল, কোন বসতির
চিহ্ন নেই। সন্ধ্যার পর প্রায় তিন চার ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেলেও এখনও কোন উপায়
হয়নি, কুটকুটে আঁধার। এমন একটি জায়গায় লরিটি আটকিয়েছে যে এক ইঞ্চি ফাঁকা
জায়গার অর্থ বিরাট ব্যাপার, তার মধ্যে রাত্রিবেলা বৃষ্টি পড়ছে। কারোর হাতে কোন
যন্ত্রপাতি নেই যা আছে তা লরি সরানোর উপযুক্ত নয়। মাছ ভর্তি একটি বিরাট লরি সরানো, সত্যই ভাবলে
গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। বর্ণনায় কতটুকু পাঠকের হৃদয়াঙ্গম হচ্ছে জানি না, এই অদ্ভুত
অভিজ্ঞতা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
আমার পেট খালি, দূর্গন্ধ, বৃষ্টি ভেজা শরীর, কারো সাথে কথা বলতে পারছি না। কন্ডাক্টারকে বোঝাতে সক্ষম হলাম আমার ব্যাগের কাপড় বের করতে হবে। গাড়ি এমনভাবে রাখা তা বার করতে গেলে পাহাড় থেকে পড়ে যেতে হবে, সম্ভব না। কোন লাভ হলো না, ভেজা কাপড়েই আছি। এই অবস্থায় পাগলের মতো আচরণ করা শুরু করলাম, কিছুক্ষণ সিটে গিয়ে বসি, ভালো লাগে না আবার বের হয়ই বৃষ্টিতে ভিজি, খারাপ লাগলে, আবার গিয়ে বসি; এমন চললো বেশ কিছুক্ষণ। একটা সময় সিটেই ঘুমিয়ে পড়ি।
আমার
পেট খালি, দূর্গন্ধ, বৃষ্টি ভেজা শরীর,
কারো সাথে কথা বলতে পারছি না।
কন্ডাক্টারকে বোঝাতে সক্ষম হলাম আমার ব্যাগের কাপড় বের করতে হবে। গাড়ি এমনভাবে
রাখা তা বার করতে গেলে পাহাড় থেকে পড়ে যেতে হবে, সম্ভব না। কোন লাভ হলো না, ভেজা কাপড়েই
আছি। এই অবস্থায় পাগলের মতো আচরণ করা শুরু করলাম, কিছুক্ষণ সিটে গিয়ে বসি, ভালো লাগে না
আবার বের হয়ই বৃষ্টিতে ভিজি, খারাপ লাগলে, আবার গিয়ে বসি;
এমন চললো বেশ কিছুক্ষণ। একটা সময় সিটেই
ঘুমিয়ে পড়ি।
কতক্ষণ
ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। বিকট হর্ণের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল। দেখি আমাদের গাড়ি ধীর গতিতে
চলছে। বাইরে তাকালে চোখে পড়ল শুধু লাইট আর লাইট। কাছেরগুলো বড়, দৃষ্টি যত
দূরে যেতে থাকে লাইটগুলো আস্তে আস্তে ছোট
হতে থাকে। পাহাড়গুলো দেখে মনে হচ্ছে নিচ থেকে উপর পর্যন্ত বিয়ে বাড়ির মরিচা বাতি
দিয়ে যেন পেঁচিয়ে সাজানো হয়েছে। এই নিকষ কালো আঁধারে যতদূর চোখ যায় শুধু আলোময়
পাহাড় দেখা যাচ্ছে। হাজার হাজার আলো আকাশের তারার মতো, সেগুলো একটু
পর পর সর্পিলাকারে ধীরে ধীরে চলছে, আমাদের গাড়ি ব্রেক করলে খানেক পরে দেখা যায় সর্পিলাকারের
মরিচা বাতি থেমে গেছে, আমার চলা শুরু করলে তার খানেক পর আবার সবগুলো চলা শুরু করে
। আমার জীবনে একসাথে এত গাড়ি কখনো দেখে নি,
আর কোনদিন দেখতে পাবো মনে হয় না। তখন
জর্জ বুশ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, গল্পটা যাকেই শোনাতাম তাকেই বলতাম এত গাড়ি জর্জ বুশও দেখে
নি আর তারপক্ষে দেখা সম্ভব না। কারণ এত গাড়ি একসাথে করা সম্ভব না, একটা দুইটা
পাহাড় হলে গাড়ি দিয়ে ভরা সম্ভব। সত্যি বলছি,
গাড়ি গুণতে পারা সম্ভব ছিল না, এমন কি খালি
চোখে পাহাড় গুণে শেষ করতে পারি নি। যতটুকু দৃষ্টি যায় সব পাহাড়ের রাস্তাই গাড়িতে
পূর্ণ, যাদের হেড-লাইট জ্বলন্ত। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ডানের বামের সামনে
পেছনে যেদিকেই তাকাই একই দৃশ্য।
আমাদের
গাড়ির বেশির ভাগ যাত্রীকে ঘুমন্ত মনে হলো। গাড়ির পেছনে সেই আলো মিছিল। এখন আর
দূর্গন্ধটা নেই বুঝলাম আমরা বিপদমুক্ত।
ক্লান্তি
আর দূর্বলতায় আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙ্গলে দেখি দিনের কচি আলো, তখনও গাড়ি
চলছে, বৃষ্টি হয়েই চলেছে। আগের সেই ভয়ঙ্কর পাহাড়ি রাস্তায় নয়, তবে রাস্তাটা
সমতলও নয়। এক জায়গায় গিয়ে গাড়ি আবার আটকালো,
একটি ঝর্ণা তার গতিপথ পরিবর্তন করে
রাস্তায় প্রবাহিত হওয়া শুরু করেছে, পানির বেগ প্রবল। রাস্তার ঠিক নিচেই একটি খড়স্রোতা ছোট নদী
প্রবাহিত হচ্ছে। গাড়ি থেকে সবাইকে নামতে হলো,
চালক যাত্রীসমেত পার হতে ভয় পাচ্ছে।
যাত্রীহীন খালি গাড়ি নিয়ে রাস্তাটুকু পার হলো। এই দূর্বল শরীর নিয়ে আমাকে নামতেই
হলো। কিছুক্ষণ পর আমাদের নাস্তা বিরতি হয়েছিল একটি রেষ্টুরেন্টে। রেষ্টুরেন্টটি
যেমন ভালো, তেমনি জায়গাটাও দেখতে খুব সুন্দর। একটি পাহাড়ের পাদদেশে, রাস্তাটি
পাহাড়ের গায়ে লাগোয়া। রেস্টুরেন্টটির দু’দিক ছিল পাহাড়ে ঘেরা;
সামনে ফাঁকা বড় জায়গা। কিছুক্ষণের জন্য
বৃষ্টি থামে আবার ঝিরিঝিরি শুরু হয়। ভালো মত ফ্রেশ হয়ে গরম গরম পরোটা দিয়ে নাস্তা
সারলাম, এই রেষ্টুরেন্টে ভাষাগত কোন সমস্যা হলো না। ভয়ে ভয়ে চা খেলাম, ঝাল-চা না হয়
আবার, না ঝাল ছাড়াই চা খাওয়া গেল। এর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমি কাঠমাণ্ডুতে
পৌঁছি।
কাঠমাণ্ডুতে
গিয়ে হোটেলের রুম থেকে একদিন বেরই হয়নি,
শুধু ঘুম আর ঘুম। কাঠমাণ্ডুতে আমার ‘বুদ্ধি’ নামের একজনের সাথে বন্ধুত্ব হয় ;
কাঠমাণ্ডুতে পর্যটন ব্যবসা করে। অনেকদিন
যোগাযোগ ছিল, এখনও মাঝে মাঝে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। তাকেই আমার এই ভ্রমণবৃত্তান্ত
প্রথম শোনাই; সে লোকাল নিউজ-পেপার দেখে এই ভ্রমণের সত্যতা নিশ্চিত হলে পরে আমাকে
জানান, আমি যে দু’চারটি জায়গার নাম বলতে এখনও পারি তা বুদ্ধি’র বুদ্ধির
জোরে। তার পরামর্শে আমি চায়না পথে না গিয়ে ঢাকা ফেরত আসি। কাঠমাণ্ডুতে আরও অনেক
ঘটনা ঘটেছে অদ্ভুত অদ্ভুত, সেটা না হয় পরে অন্য আরেকদিন বলবো।