আজ

একটি গ্রাম্য পাঠাগার



এমরান হোসেন রাসেল©


জীবন মানেই অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতার নামই জীবন। সব অভিজ্ঞা কাজে লাগে না, কিছু অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ না হওয়াই ভালো, তেমনি এক অভিজ্ঞতার কথাই আজ বলছি।

পেটের দায়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরতে হয়েছে, এখনও হয়। এই ঘুরন্ত জীবনে দেশে দক্ষিন-পশ্চিম অঞ্চলের এক উপজেলায় কয়েকদিন থাকা হয়েছিল। যখন ঢাকার বাইরে যাই, মোটামুটি কাজ মিটিয়ে অবসরটুকু প্রান্তিক জনসাধারণের সাথেই আলাপ করি, কিছু জানার চেষ্টা করি। তেমন সুবিধার না হলে পর রিক্সা/ভ্যান ভাড়া করে ঘুরি। সেই চালকের ছাত্র হয়ে যাই, প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করি।

উপজেলা শহর, মোটামুটি ছিমছাম। কর্মসূত্রে কয়েকজন সাংবাদিক, স্কুল-কলেজ শিক্ষকগণের সাথে আলাপ হয়। তাঁদের বেশির ভাগের আলোচনা প্রাপ্তিযোগ মূলকহয়েছে হচ্ছে আর হবে এমন, সবটাই ব্যক্তিস্বার্থ সম্পর্কিত। কয়েকজনের সাথে আলাপে উপরি-আন্তরিতার সূত্রপাত হয়। তেমনি এক আন্তরিক কলেজ-শিক্ষকের সাথে আলাপকালে সুযোগ বুঝে জানতে চাইলাম, ‘এখনও বই-টই পড়ার অভ্যাস...কথা শেষ করার আগেই তিনি মসজিদ দেখি দিলেন, বললেন অবসরে মৃত বাবার জন্য এবাদত-বন্দেগি আর দোয়া-খয়রাতে সময় কাটান। আর আমাকেও পরকালের কিছু নসিয়ত করতে ভুল করলেন না, আমি চুপ হয়ে গেলাম।

আমার একাকী সাদা-কালো জীবন, অরঙিন। সাদা আর কালো দিয়েও ভিন্ন রঙ হয়, তবে তাকে বলে ধূসর। সেও সাদা-কালোই, কখনও কালোর নিকটে নয়তো কখনও সাদার। এই অবস্থায় মানুষ প্রকৃতি থেকে রঙ ধার করে নিজ-মন রঙিন করার চেষ্টা করে, তাতেই তার আত্মপ্রসাদ। আমিও তাদেরই একজন। যাক সে কথা, কাজ শেষে কথা বলায় সময় নষ্ট না করে একা একা ভ্যান ভাড়া নিয়ে ঘুরি, গ্রাম্য গাছগাছালি, পাখপাখালি দেখে মনকে রঙিন করা চেষ্টা করি; মন্দ লাগে না। সেদিন বিকেলে বেরিয়েছি এখানকার নাগরিক জীবন যতটুকু দেখা যায় দেখবো ভেবে, একজন মধ্যবয়সের ভ্যানচালকের ভ্যানে। এখনও বাংলাদেশের উপশহরগুলোর আবরণ শহুরে কিন্তু আত্মায় গ্রামীণ। সাধারণত এমন গ্রামীণ-শহরগুলোতে ঘুরবার সময় আমি একটি শুমারি করি, তা হলোসেখানে বই, ওষুধ বা চায়ের/বিড়ি দোকান গণনা। আমার মনে হয় এতে আমি সেই জনপদের মোটামুটি একটি ধারণা পাই। অল্পসময়েই পশ্চিমদিক বাদে পৌর-শহরটি দেখা হয়ে গেল। চায়ের দোকান সত্তুরটি গণনার পর চায়ের দোকান গণনা বাদ দেই, ওষুধের দোকান ছোট-বড় মিলিয়ে কম করে হলেও ৪০/৫০টি আর পাঠ্যপুস্তক-সুলভ বইয়ের দোকান মোটে চারটি। বইয়ের দোকানের স্বল্পতা আমাকে বিস্মিত করে ! দুটি কলেজ, ৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আট-দশটি (আনুমানিক) প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয়, একটি আলিয়া মাদ্রাসা, একটি মহিলা মাদ্রাসা আর অসংখ্য কউমী-মাদ্রাসাময় উপশহরে এত অল্প বইয়ের দোকান কেন? কৌতূহল মেটাতে সবচেয়ে বড় দোকানটিতে একটি কলম কেনার বাহানায় ঢুকে কলম চাইতেই দোকানের একটু ভিতরের একটি ছোকরা ছেলে বলল, ‘স্যার এখানে। দাম মিটাতে ইচ্ছাকৃত বড় নোট দিয়ে দোকানটির চারপাশ দেখতে লাগলাম। পাঠ্য-পুস্তকের পাশাপাশি মরণের আগে ও পরে’, ‘জিন-ও-ফেরেশতাদের-বিস্ময়কর-ইতিহাস’, ‘আদর্শ স্বামী-স্ত্রীর মধুর মিলন’,নির্বাচিত বিবেকানন্দ শ্রেণীর বইয়ের প্রতুলতা চাহিদা-যোগানের অর্থনীতির সূত্র মনে করিয়ে দিচ্ছে। দোকানের উপরের দিকে একটি সেল্‌ফে নজর পরতেই দেখলাম ধূলা-মণ্ডিত ধূসরকেশের শরৎচন্দ্র উকি দিয়ে আছে আমার দিকে

পরের দিন বিকেলে আবার বাউণ্ডুলেপনা। শহুরে লেবাসের কারণে সহজেই ভ্যান মিলে। দুপয়সা বেশির লোভে ভ্যানচালকেরা সহজেই রাজি হয়। গতদিন উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দেখা হয়েছে, তাই আজ শহরের পশ্চিমে চললাম। ক্লান্ত-শ্রান্ত সূর্যের ফেরার প্রস্তুতি সাথে দূর-দূরান্তের মানুষের পাল্লা দিয়ে বাড়ী ফেরা ব্যস্ততা সহজেই দেখা যায়। আরেকটু এগুলে সামনে একটি বড় খেলার মাঠ, ডান পাশে একটি সরকারী পুকুর। পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে দেখা গেল ভিক্ষুক, ভ্যানচালক, নির্মাণশ্রমিকরা নিজেদের বঞ্চিত জীবনের কঠিন সত্যকে হাসি মুখে ধুয়ে মানুষ্য সমাজে নিজেকে উপযুক্ত করাতে ব্যস্ত। সভ্যতার সুন্দর ও প্রাণবন্ত চেহারাটি ঠিক রাখতে পুকুরটি নির্বিবাদে শুষে নিচ্ছে বঞ্চনা, গঞ্জনা আর ঘামরূপি রক্তকে, হয়তো তাই পুকুরে গাঢ় কালো পানি। পাশের মাঠেই দেখা যাচ্ছে ধূলির ঝড় তুলে খেলা করে আনন্দে মত্ত থাকা কিশোর-বালকের দল। এ বিনিময়হীন পরিশ্রমশুধুই আনন্দের, শুধুই খুশির। কিশোর-বালকের আনন্দ-খুশি মনকে করে তুলছে পরশ্রীকাতর আর হিংসুটে। জীবন এখন যেখানে, এমন নিষ্পাপ-আনন্দময় জীবন চাইলেও সম্ভব নয়। জীবনের এই প্রাচুর্য, কোলাহল আর কলরব মনকে স্মৃতিকাতর করে তুলে। চোখের সামনে মনের সামনে থাকা সবকিছু ঝাঁপসা হতে হতে হারিয়ে যায় কিশোরবেলায়। কৈশোরের স্মৃতিগুলো আর স্মৃতি থাকে না হয়ে উঠে বর্তমান। নিউরনের অনুরননে কখন যে হারিয়ে গেছি বুঝতে পারি না। হঠাৎ ভ্যানচালকের প্রশ্নে সংবিৎ ফিরে আসে।
চালকের প্রশ্ন স্যার, আরও সামনে যাবেন?’ আমি নিজেও তো জানি না আমি আরও সামনে যাবো কিনা? কিছু সময় পেছনে ফিরে যেতেই ভালো লাগে, পেছনে পরে থাকতেই আরাম লাগে। আমাদের মন দুঃখগুলোকেই স্মৃতিরূপে জীবন্ত রাখে, সেগুলো পাহাড়ের মতো বিশাল, মরুভূমির মতো নিষ্প্রাণ, জঙ্গলের মতো জঞ্জাল আর সাগরের মতো উত্তাল। সেই পাহাড়-মরুভূমি-জঙ্গল-সাগরের চিপা-চাপায় দুএকটি ভিন্ন স্মৃতি থাকে যা ঘন সুখপ্রদ। স্মৃতি সুখে ছেদ পরে,তাই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
বললাম, ‘তোমাকে কী থামতে বলেছি ? সামনে চলো।

স্যার,সন্ধ্যে হইয়ে গেছে’, একটু দম নিয়ে আবার বলে সামনে কবরস্থান !

আমিও চারিদিক তাকিয়ে দেখি প্রায়ান্ধকার আর বিশাল বিশাল মেহগনি, কড়ই গাছের বাগান। ঝিঁ ঝিঁদের ডাক চরা হচ্ছে। সামনে কোন ঘর-বাড়ি দেখা যাচ্ছে না, পিছনে তাকাতে ফেলা আসা বাড়ি-ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে না। বললাম ঘুরাও। চালক সাথে সাথে ফিরতি পথ ধরলো।

সান্ধ্য-আলোয় কিছুক্ষণ চলার পর দূরে একটি আলো দেখা গেল। কিছুটা সামনে গেলে বোঝা গেল ছোট একটি ঘর। ভ্যানে বসলে চালককে বিভিন্ন প্রশ্নে ব্যস্ত রাখাই অভ্যাস, আজ তা হলো না। কেমন যেন চুপ হয়ে গেছি, কৈশোরে চলে গেছি বলে কি?

স্যার, এখন আর ডর-ভয় নাই

ভয় নাই কেন?’ জিজ্ঞেস করলাম।

ঐযে ঐ ঘরের পরে বামে যে মোড়টা দিখতে পাচ্ছেন না, তারই বামে গেলে উপজেলা মাঠ।এবার তার কন্ঠে স্বাভাবিক স্বর।

আমরা এ পথেই তো এসে ছিলাম, তাই না ?’ আমার প্রশ্ন।

হ্যায়, স্যার

স্যার, এই দিকটাতে এমনিতেই লোক চলাচল কম। কবরস্থানটার জইন্যে বিকেলের পর এদিক দিয়ে লোক চলাচল নাই বললেই চলে। কবরস্থানের পিছমুরায় একটি পাড়া আছে, তারাই দিনের সময় এই পথে চলাচল করে। অন্যসময় হাসপাতালের দিক দিয়া তারা আসে-যায়।একদমে কথাগুলো বলে যেন শান্তি পেলো।

ঘরটির প্রায় কাছে এসেছি। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে ঘরটি রং করা হচ্ছে। ঘরটির বাইরে ছড়ানো-ছিটানো চার-পাঁচটি চেয়ার, দুটি টেবিল আর রং দেওয়ার সরঞ্জাম। ঘরের ভেতরে দৃষ্টি দিতেই দেখলাম একটি সাইনবোর্ডে লেখা উপজেলা পাঠাগার। সাইনবোর্ডটি নতুন রং করা, সহজেই বোঝা যাচ্ছে।
এ্যাই, আমি তোমার ভ্যানে যেখান থেকে উঠেছি, সে জায়গা আর কতদূর? চালককে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, ‘দূর নাতো, মাঠটার ওপাড় থেকেই তো উঠলেন !

পাঠাগারের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করলাম, ‘মাঠ কতদূর’?

স্যার যে কি কন না, ঐযে রাস্তার মাথায় মাঠ

একশগজের মাথায় রাস্তা বাঁক আর মাঠের একটি কিনারা বোঝা যাচ্ছে। আমি এখানেই নামবো। থামো।

এখানেই নামবেন?’

হ্যাঁ।

ভাড়া মিটিয়ে, ভ্যান বিদায় দিলাম। ঘরটির ভেতর ঢোকার পর দেখা গেল দুটি সমবয়সী ছেলে আসবাব-পত্র গোছাচ্ছে। তিনটি মাঝারি সাইজের স্টিলের সেল্‌ফ পাতলা কাপড়ে ঢাকা থাকলেও সেগুলোতে কিছু বই দেখা যাচ্ছে। ছেলে দুটি ধরাধরি করে চেয়ার-টেবিলগুলো বাইরে থেকে ঘরে এনে সাজাচ্ছে।

এটা যে লাইব্রেরি তা সাইনবোর্ড দেখে আন্দাজ করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনাদের লাইব্রেরি বন্ধ হবে কখন?’

ফর্সা, গালে হালকা দাড়ি, চোখ দুটো ঘোলা ছেলেটি বলল গোছানো পর্যন্ত আজ খোলা

খোলা থাকে কখন থেকে কখন?

বিকেল চারটায় থেকে রাত আটটা।হাতের কাজে ব্যস্ত ছেলেটি আবার বলল, ‘আজ রঙের কাজ শেষ হলো, বসা যাচ্ছে না, রং-টং পরিস্কার না করলে বসা যায় ?’

যুক্তিসঙ্গত কথা, আগামীকাল আসবো ভেবে বের হয়ে গেলাম। এত নিরব জায়গায় ভ্যান না পেয়ে অগত্যা হাঁটা শুরু করলাম। আমার ছোটবেলার লাইব্রেরিতে যাতায়াতের স্মৃতিগুলো মনে পরতে লাগলো। সেই ব্লু কালির ইকোনো বলপয়েন্ট আর নিউজপ্রিন্টের দিস্তা খাতা। প্রতি শুক্রবার খাতাটি প্যান্টের পেছন-পকেটে গুঁজে আট আনা ভাড়ায় সদরঘাট টু গুলিস্তান বাস যাত্রা। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরিতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টার নিরবছিন্ন সময় কাটিয়ে দেওয়া। স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠলে যাত্রার ব্যাপ্তি ঘটলো, গুলিস্তান পেরিয়ে শাহবাগ হলো গন্তব্য, জাতীয় গ্রন্থাগার হলো ঠিকানা। মনের ভেতর এইসব চলছে সাথে পা-ও চলছে। একসময় দেখি মাঠ পেরিয়ে এসেছি।

পরেরদিন একটু আগে আগেই বের হলাম। লাইব্রেরির দরজায় পৌঁছে দেখি, লাইব্রেরির দুটি দরজাই বন্ধ। ঘড়িতে চারটা দশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফর্সা ছেলেটি এসে ঘর খুলে পরিস্কার শেষে ডাকলো, ভিতরে ঢুকতে দেখা গেল ঘরটি গতকালের চেয়ে বেশ পরিপাটি। একটি অফিস টেবিল এক কোণে, পাশে একটি চেয়ার, ঘরটির মাঝখানে দুটি বড় টেবিলকে ঘিরে নয়টি চেয়ার, দুই দিকের দেয়ালে দুটি এনার্জি ভাল্ব আর পূব দেওয়ালে একটি বন্ধ ঘড়ি আর টেবিলের উপর যুগান্তর, প্রথম আলো, New Asian Age-সহ অন্যান্য স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা। বইয়ের সেল্‌ফগুলো আমাকে যেন বহুগুণ চৌম্বিক শক্তিতে টানছে। ছেলেটিকে বললাম, ‘আমি কী বইগুলো পড়তে পারবো?’

হ্যায়,। কিন্তু বেশিভাগ বইয়ের যে অবস্থা !

নিজ অস্থায়ী গন্তব্যের দিকে হাটতে হাটতে ভাবছিআমাদের সমাজের কর্তাব্যক্তিদের কথাযাঁরা কেউ কিস্তি মাতে ব্যস্তনয় তো কেউ সাপের কামড় খেয়ে লেজে গিয়ে পৌঁছুছেন।

আমি বইয়ের সারিগুলো দেখতে লাগলাম। বেশির ভাগই বেশ পুরোনো, অঙ্গ-সৌষ্ঠব হীন, কোন কোনটা গ্রন্থকীটদের বাঁচিয়ে রেখেছে, অনেকেরই চেহারায় ছুলির দাগ স্পষ্ট। ঘরে রঙ করা হয়েছে বলে এমন মনে হলো। দুটি বই হাতে নিলাম, পেছন থেকে ছেলেটি বলল, ‘দাঁড়ান আমি মুছে দিচ্ছি। এত ধূলায় পড়তে পারবেন না। এই বইগুলো সচরাচর কেউ নাড়াচাড়া করে না; তিন নম্বর র‍্যাক দেখিয়ে বলল, ঐ বইগুলোই কিছুটা ধরাধরি হয়, নাওয়া-নেওয়ি হয়

বই দুটি তার হাতে দিয়ে তিন নম্বর র‍্যাকের দিকে এগুলাম। দুই নম্বর র‍্যাকের উপরের তাকে কিছু নতুন বই এই ১৫/২০টা, মাঝের তাকে পাঁচটি দাবার সেট, লুডু বোর্ড, একটি ফুটবল আর একটি হ্যান্ডবল, নিচের তাকে পানি খাওয়ার গ্লাস, চায়ের কাপ-পিরিচ পেরিয়ে তিন নম্বর র‍্যাকের বইগুলো দেখলাম। এইগুলো তুলনামূলক নতুন। বইগুলোর শিরোনামেই  ভেতরের বিষয়বস্তু যে স্তুতিমূলক তা বোধগম্য হয়। নামাজ শিক্ষা, মোকছেদুল মমিন, হজ্জ শিক্ষা, সহিত চল্লিশ হাদিস, তাপসী রাবেয়া বসরী থেকে শুরু করে স্থানীয় এম.পির কর্মযজ্ঞ আর স্মারকগ্রন্থে পূর্ণ।

নেনবলে বই দুটি আমার হাতে দিয়ে ছেলেটি আবার তার নির্ধারিত চেয়ার গিয়ে বসল। তিন-চারটি ছোট ছেলে কিচিমিচির করতে করতে ঘরটিতে ঢুকল। শামীম ভাই, দাবার কোট দাও, টিএনোসাব নাকি দাবা দিয়েছে। একটি ছেলে বলে উঠলো, ‘তুই কি খেলতে জানিস যে খেলবি, আমি লুডুই খেলুম, ঐ মোস্ত তু্ই আমার সাথ খেলবিনে?’

এ্যায়, চিল্লাছিস ক্যান ? চুপ অ।শামীমের হুঙ্কারে ছেলেগুলো কিছুটা দমে। দিচ্ছি, তোরা চিল্লাবিনে আর নতুন চেয়ার-টেবিল এগুলো নষ্ট করিসনে না য্যান, তাইলে বলো আর ঢুকতে দিবানি না। একটি দাবার কোট আর একটি লুডুর কোর্ট দিয়ে শামীম নিজ জায়গায় যায়।

এই পরিবেশে বইয়ের পাতা উল্টানো গেলেও বই পড়া যায় না। তাই কয়েকটি বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকলাম। পিচ্চিদের পর একজন মধ্যবয়স্ক, আরেকজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক কখন যে ঢুকেছে বুঝতেই পারিনি। বুঝালাম যখন বৃদ্ধ বলে উঠলো, ‘শামীম, টিএনোসাবটা বালা-ই, ম্যালা জ্ঞানী লোক, নতুন পেপার নিতে শুরু করেছি নাকি, এখানকার পেপারে অত খবর থাকে না, পইরা যুত অয় না।শামীম ছেলেটির ছোট্ট জবাব, ‘হু

বৃদ্ধ একটু পরে আবার বলা শুরু করলো, ‘তাআলি ইংরাজি পত্রিকা ক্যান? পড়বিনে ক্যাটা?’

টি.এন.ও স্যার ইংরেজিটাও পড়েন, ঐটা তোমরা না পড়লিও চলবেনেশামীম কিছুটা বিরক্তভাবেই বলে।

এবার মধ্যবয়স্ক লোকটি পত্রিকার পাতায় চোখ রেখেই জানতে চাইলো, ‘কম্পিউটার, প্রিন্টার, ইন্টারনেটও আসার কথা, কবে নাগাদ আসছে?’

হ্যাঁ, স্যার।দুই একের মধ্যেই এসে যাবেনি।

আটটা বাজলেই তো বন্ধ কর, তাই না ? বেতন বাড়িলো, নাকি বারো শটাকাই বহাল থাকিলো?

সময় আগেরটাই আর বেতনও আগের মতোই !

কোন ব্যাংক কিছু বই দিবেনি শুনলাম !বৃদ্ধের প্রশ্ন।

হ্যায়’, শামীমের উত্তর।

কি বই দিবেনি? কত টাকার বাজেট ? অন্যজনের কৌতূহলী প্রশ্ন

স্যার, তাতো জানিনে।

বাংলা বইপতর না দিয়ে হাদিস-কোরানের বই দিতে বলনি, আজকাল ছাওয়াল-পাওয়ালের যে অবস্তা তাতে হাদিস-কোরান না পরলে দুনিয়াতে গজব পরতে সময় লাগবেনি না। যাই, মাগরেব হইয়া আইলো,যাই মজিদে যাই।

বাচ্চা ছেলেগুলোর চেঁচামেচি ক্রমশ বাড়তে থাকে। লুডু পক্ষরা একে অন্যকে সাপের কাপড় খাওয়াতে চেঁচাচ্ছে। এক পিচ্চি খেলায় জয়ী হয়ে চেয়ারের উঠে, ‘জিতছি জিতছিবলে গলা ফাটিয়ে তুলল।

অন্য ভদ্রলোক পিচ্চিদের ছোট গলায় ধমক দিয়ে বেড়িয়ে গেলেন। পরিবেশ আমারও ভালো লাগছে না। বেরিয়ে যাওয়ার আগে দুএকটি প্রশ্ন করলাম লাইব্রেরিয়ান ছেলেকে, ‘এখানে খেলাধুলা সামগ্রী কেন? লাইব্রেরিতে নয় ক্লাবে খেলাধুলার সামগ্রী থাকে জানি !

স্যার, লাইব্রেরিটা বন্ধ ছিল বছরের পর বছর। কোন লোকজন আসতো না এখনও আসে না, তাই খেলাধুলা জিনিস। এতে ছোট ছোট ছাওয়ালরা অন্তত আসে। দৈনিক পত্রিকা পড়তে দুচার জন বড় মানুষ আসে তাও অনিয়মিত। বই কেউ চায় না তবে দুএকজন ধর্মীয় বই নিতে প্রাইমারী স্কুলের ম্যাডামরা আসেন।

আমি আবার প্রশ্ন করি, লাইব্রেরির পক্ষ থেকে বই পড়ানোর কোন কার্যক্রম নেই?

স্যার, কে করবে? আমি ইউ.এন.ও (এই প্রথম UNO সঠিক উচ্চারণে শুনলাম) স্যারের অফিসের পিয়ন, আমাকে UNO-স্যারের অফিস কাজ সেরে চারটায় লাইব্রেরি খুলতে হয়; যদি স্যারের কাজে চাপ থাকে তবে কোন কোনদিন দেরিও হয়।  এখানে প্রতিদিন বসতে হয় রাত আট-টা পর্যন্ত, সময় কৈ?

এমন সময় একজন নাক-মুখ ঢাকা, বোরকা পরা ভদ্রমহিলা এসে শামীমকে গেট থেকেই বললো, ‘শামীম তোমাদের হযরত খাদীজা (র:)এই বইটি আছে, আর এই নাও আগের বইটিবলে হাতের ব্যাগ থেকে একটি বই বের করে টেবিলের উপর রাখলেন। তাকিয়ে দেখলাম, ‘ইয়াজিদ কারবালা হাসান হোসায়েন

ম্যাডাম, আসেন, আসেন বলে শামীম ঐদিকে ব্যস্ত হয়ে গেল।

আমি বের হয়ে গেলাম। বের হওয়ার সময় কানে আসলো ম্যাডাম নতুন বই আসছে, বেশির ভাগ ইসলামী বই।বাইরে থেকে এক পিচ্চি ছেলেকে চেঁচিয়ে বলতে শুনলাম, ‘টিএনোসাবের ম্যালা বুদ্ধি, আমাগো কথা মনে রাখছে, এহন থেইয়ে আমরা রোজ দাবা খেলতে পারবিনে।  

নিজ অস্থায়ী গন্তব্যের দিকে হাটতে হাটতে ভাবছি, আমাদের সমাজের কর্তাব্যক্তিদের কথা, যাঁরা কেউ কিস্তি মাতে ব্যস্ত, নয় তো কেউ সাপের কামড় খেয়ে লেজে গিয়ে পৌঁছুছেন।


বি:দ্র: পরে আর যাইনি কিন্তু ভিন্নসূত্রে জানতে পারি।


১)
সেই লাইব্রেরিতে কম্পিউটার, প্রিন্টার, ইন্টারনেট আর সৌরবিদ্যুতের সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু বই এখনও আসেনি।

২) সেখানে পাঠ্যপুস্তক (বিনামূল্যে সরকারী পাঠ্যপুস্তক ছাড়া) খুব একটা বিক্রি হয় না, শুধু গাইড বই দিয়েই স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় পড়ানো হয়।