এমরান হোসেন রাসেল©
যান্ত্রিক
পর্দায় ভেসে উঠা কিছু লেখা, কিছু ভাবনা, কিছু আশা বা হতাশায় মিল হলে পর বন্ধুত্বের আহ্বান বা
আহ্বানে সাড়ায় আমার ফেসবুক বন্ধুমহল। যাঁদের কণ্ঠ অজানা, অবয়ব অদেখা; কারো সাথে
কোনদিন দেখা হবে, কথা হবে এই ভাবনা কোনদিন মনের দরজায় টোকা দেয়নি। পারতপক্ষে
ফোনে/মোবাইলে কথা হবে এমনও ভাবায়নি আমার মন আমার মগজকে। তবু প্রতিদিনের কিছু সময়
এমনই অজানা-অদেখাদের সাথে আমার বসবাস এক বিনে সুতায় গাঁথা। প্রত্যেকেই যেন এক একটা
চোরকাঁটা, যাঁরা ছোঁয়া-ছায়াহীন।
এই
মায়াজালেও (ইন্টারনেট) স্নেহ-শ্রদ্ধার উৎপাদন হয়। ভালোবাসার শিশির পাঁজরভেদী হয়
অনেক সময়, তাতে হৃদয় সিক্ত হয়। নীল হয়ে যাওয়ার মতো দুঃখও যে নেই, তেমন নয়।
সুষম-বিষম উভয়ই অনুভূত হয়। হৃদয়ের উজান-মাঝিদের জন্য উজ্জীবিত আমি, আমরা সবাই।
আমার
একটু সুবিধা আছে, তা হলো আমার ফেসবুক বন্ধুমহলের প্রায় সবাই মায়াজালের
বইপ্রেমী একটি জংশনে সক্রিয়। স্বীকার করতেই হয় বইয়ের দেন-দরবার করতে ও রক্ষা করতে
আমার হৃদয়ের উজান-নাউরিয়াদের সাথে সখিত্ব।
প্রায়
একবছর আগে এমন একজনের সাথে বই নিয়ে আলাপের শুরু। সাহায্য চেয়ে লিখেছিলেন; সাধ্যানুরূপ
সাহায্য করলাম। কয়েকদিন পরই বন্ধুত্বের আহ্বান। আহ্বানে সাড়া দিয়ে জানলাম, সে কোলকাতা
নিবাসী একজন অনূঢ়া, উচ্চশিক্ষিতা,
বই-পড়ুয়া, সুবিধা-বঞ্চিত মানুষ তাকে ভাবায়, তেমনি ভাবায়
তাঁর মৃত বাবা। অনেকগুলো বই এর অনুরোধ থাকলে মাত্র কয়েকটিই দিতে পেরেছিলাম।
প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থায় বিদ্রোহী মানুষটি নকশাল আন্দোলন নিয়ে কোন বইয়ের জন্য
অনুরোধ করলে একটি বই ভাগাভাগি করি। এরই মধ্যে জন্মদিন চলে আসলো, জন্মদিনের
শুভেচ্ছার প্রত্যুত্তরে খুশির প্রকাশ যান্ত্রিক-পর্দা মেলে ধরে। ‘মোনালিসার
প্রেম’- নারায়ণ স্যানাল বইটির অনুরোধ দেখি একদিন। যে বইয়ের নামের
আদি-মধ্য-অন্তে প্রেম থাকে তার থেকে আলোকবর্ষ দূরত্ব বজায় রাখি। আমি এমন রসহীন
মানুষ যে, নামটি শুনেই কেমন অস্বস্তি শুরু হলো; এতে মোটেই লেখক ও বিচক্ষণ পাঠকের
কিচ্ছুই যায় আসে না। নিজের সংগ্রহে নেই,
শতভাগ নিশ্চিত; তবুও ইচ্ছার
বিরুদ্ধেই খুঁজে দেখবো টাইপ উত্তরে হালকা হই। মায়াজালের একটি জায়গায় নারায়ণ
স্যানালের মোনালিসাকে ঝুলতে দেখে, ক্ষণমাত্র দেরী না করে তাঁকে খোঁজ দিয়ে, নিজেকে
তড়িৎকর্মা ভাববার ছুতো খুঁজে পাই। মাঝে দু’এক বার পরিবার,
বাবা-মা, পড়াশুনা নিয়ে কথা হলে বন্ধুত্বের
রং হালকা থেকে গাঢ় হয়েছে মনে হলো। আমার অন্যান্য সখা-সখিদের মতো তাঁর সাথেও সখিত্ব
এভাবেই গতিময় রইল।
একদিন, খুব সম্ভব
খ্রিস্টানদের বড়দিনের আগের দিন ফেসবুকে যাঁদের সাথে নিয়মিত সখ্যতা, যোগাযোগ
তাঁদের প্রোফাইল পিকচারে তুষারপাত হচ্ছে,
মনে জানার আগ্রহ হলো কিন্তু মান হারানোর
ভয়ে তাঁদের কাছে জিজ্ঞেস করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে তাঁকেই প্রশ্ন করলাম; তিনি প্রশ্নটা
কী বুঝলেন জানি না, উত্তর আসলো তাঁর ছবিটা বহু আগের এবং সাথের জন তাঁর বাবা, গ্যাংটক
ভ্রমণে গেলে সেখানে তোলা। এখানে একটি কথা বলি, বাবা-মেয়ের জড়িয়ে ধরা ছবিটি আমার
দেখা প্রথমদিন থেকে আজও পর্যন্ত অপরিবর্তনীয় অবস্থায়ই আছে। বুঝলাম আমরা দু’জনই এবিষয়ে
অজ্ঞতার অভিন্ন গোত্রের। কথার পৃষ্ঠে লিখলাম,
আমি জানি তাঁর বাবা আমাদের মাঝে নেই।
উত্তরে তিনি লিখলেন, “না, আছেন; আমার মনের মধ্যে। প্রার্থনা করুন যেন সাড়া জীবন থাকে।” এমন কথায়
উত্তরে কী লিখবো ভেবে পাচ্ছিলাম না, তাই সান্তনামূলক দু’এক কথার পর, আলাপের ইতি টানলাম। বুঝলাম, বাবার কথায় তাঁর মন খারাপ হয়ে
গেছে এবং এও বুঝলাম বাবার স্মৃতির মাঝেই তাঁর বাস।
নতুন
বছরের শুভেচ্ছা বার্তা দিয়ে জয় গোস্বামীর ‘মা নিষাদ’ কবিতার বইয়ের অনুরোধ করলেন। প্রেমহীন মানুষের আবার কবিতা
ভালো লাগে নাকি? তাই কবিতার বই সংগ্রহে নেই, এ তো আর বলা যায় না। কিছুটা
অবহেলায়, অনাদরে তাঁর অনুরোধ পড়ে রইল আমার টাইমলাইন নামক প্রচ্ছদপাতায়। একদিন দু’দিন করে এভাবে
চলে গেল দু’মাস। হঠাৎ মনে হলো বইটির খোঁজ করে দেখি পাই কিনা। পেয়েও গেলাম। আবারও
আমি তড়িৎকর্মা হয়ে কালক্ষেপণ না করে বইটির খোঁজ দিয়ে দেই । একদিন, দু’দিন পার হয়ে
গেল; না কোন কৃতজ্ঞতা, না কোন ধন্যবাদ।
অন্য সময় তো এমন হয় না। বইয়ের খোঁজ দেওয়ার সাথে সাথেই থাকে ধন্যবাদ সহ সহজ-সরল
প্রাপ্তিস্বীকার। ভাবলাম, অসুস্থ থাকতে পারেন। কিন্তু মায়াজালের আধুনিক দিনে কোন
কিছু জানতে বেশি সময় লাগে না। তাই তাঁর লাইমলাইনে গিয়ে হাজির হলাম। অন্যান্য
কয়েকজনের রোমান হরফে বাংলাভাষার পোস্ট দেখলাম, যা এড়িয়ে যাওয়া আমার স্বভাব।
খুঁজলাম তাঁর নিজের করা কোন পোস্ট, না তাও নেই। নিচের দিকে বাংলায় একটি পোস্ট নজরে পড়লো এমন :
“কলকাতার বন্ধু (বন্ধুটির নাম গোপন থাকলো, তাঁর সম্মানে)
দিদি আর নেই। আজ উনাকে ট্যাগ করে উনার বান্ধুর করা পোস্ট থেকে জানতে পারলাম। খুব
সহজসরল ছিলেন (বন্ধুটির নাম গোপন থাকলো,
তাঁর সম্মানে) দিদি। মাঝে মাঝে চ্যাট হতো
উনার সাথে। আমাকে ভাই বলে ডাকতেন। বাংলাদেশ নিয়ে উনার অনেক আগ্রহ। বাংলাদেশ নিয়ে
জানতে চাইতেন আমার কাছে। সময় আর সুযোগ হলে বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। আমিও ইন্ডিয়া
যাবো বলছিলাম। আর এখন তিনি চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। গত ২০ ফেব্রুআরি তার বাবার
প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে চলে যাওয়ার সময় বেছে নিলেন। নিউজটা পাওয়ার পর থেকে মাথা
ঝিমঝিম করছে। যেখানে থাকুন ভালো থাকুন
(বন্ধুটির নাম গোপন থাকলো, তাঁর সম্মানে) দিদি। আপনাকে কখনো ভুলতে পারবো না” (তাঁর বন্ধুটির
মন্তব্যটি হুবহু তুলে দেওয়া হলো)
হঠাৎ-ই
যেন হৃদয়টা বিদীর্ণ করে দিল, উপরের লেখাগুলো। কিছুক্ষণ নিজেকে জগৎশূণ্য মনে হলো। কী, কেন, কিভাবে, কোথায় এসব
প্রশ্ন মাথায় এসে ভীড় করতে থাকলো, একে একে। এখনও চ্যাট ক্লাউডে তাঁর বাবার সাথে তোলা ছবিটি
আমার যান্ত্রিক-পর্দায় ভেসে উঠে, ছবিটি যেন আজ সার্থক,
দু’জন এক সাথে ছিল না মাত্র একবছর। এমন পিতৃ-স্নেহ চাইবো, কি চাইবো না, বুঝতে পারছি
না।
(আমার ফেসবুক-বন্ধুটি সম্পর্কে আমার জানাটুকু থেকেই বিচার
করে লেখা)